PRESS RELEASE






পেস্টিসাইডস ম্যানেজমেন্ট বিল ২০২০ ভারতীয় কৃষক ও কৃষির পক্ষে ক্ষতিকর; এই বিল পাশ হওয়ার আগে পুনরালোচনা প্রয়োজন

পি এম বি র খামতিগুলো ভারতের খাদ্য সুরক্ষা, ফলনশীলতা এবং কৃষকদের আয়ের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে


নতুন দিল্লী, ১২সেপ্টেম্বর ২০২০: পেস্টিসাইডস ম্যানেজমেন্ট বিল ২ ০২০ (পি এম বি) বা কীটনাশক ব্যবস্থাপনা বিল রাজ্যসভায় পেশ করা হয়েছিল ২৩শে মার্চ ২০২০। ইন্সেক্টিসাইডস অ্যাক্ট ১৯৬৮ র পরিবর্তে এই আইন বলবৎ হওয়ার কথা। বর্তমানে ভারতে কীটনাশকের রেজিস্ট্রেশন, তৈরি, রপ্তানি, বিক্রি এবং ব্যবহার চলে ১৯৬৮র ঐ আইন অনুযায়ী। পি এম বি র উদ্দেশ্য মহৎ হলেও এর খামতিগুলো ভারতীয় কৃষক এবং কৃষির স্বার্থের পক্ষে ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে।

চাল ও শাকসব্জি উৎপাদনে পশ্চিমবঙ্গ দেশে এক নম্বর; যদিও ডাল, তৈলবীজ আর ভুট্টার চাহিদার সাথে উৎপাদনের বিরাট ব্যবধান। ২০১ ৭-১৮ থেকে ২০১৮-১৯ এ চাষের জমির পরিমাণ ৫.৯৪ মিলিয়ন হেক্টর থেকে বেড়ে ৬.৪১ মিলিয়ন হেক্টর হয়েছে (সূত্র: ডিরেক্টরেট অফ ইকনমিক্স অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিক্স, ডি এ সি অ্যান্ড এফ ডব্লিউ), তবু এই রাজ্যে প্রান্তিক কৃষকদের মধ্যে ঋণগ্রস্ত চাষী রেকর্ড ৯১.১% (কৃষি ও কৃষক কল্যাণ মন্ত্রক থেকে প্রকাশিত কৃষি পরিসংখ্যান ২০১৯ অনুসারে)। এত দেনার দায় থাকায় কীটনাশক ব্যবস্থাপনা বিল ২০২০ (পি এম বি) কৃষকদের দুর্দশা আরো বাড়িয়ে তুলবে। কারণ ফসল বাঁচাতে কীটনাশক বড় ভূমিকা নেয় আর এই বিল কীটনাশক উৎপাদনে বাধা দেবে।

বিলটা ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হতে চলা সংসদের মৌসুমি অধিবেশনে আলোচনা এবং পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য পেশ হওয়ার কথা।

কেন্দ্রীয় সরকারের লক্ষ্য ২০২২ এর মধ্যে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করা। বর্তমান চেহারায় পি এম বি র মধ্যে এমন অনেক খামতি আছে যেগুলো সেই লক্ষ্য পূরণে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করবার লক্ষ্যে গঠিত কমিটি তাৎপর্যপূর্ণভাবে মন্তব্য করেছে: “ভারতে কৃষকদের ১৫ থেকে ২৫% ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয় আগাছা, কীটপতঙ্গ, উদ্ভিদের রোগ এবং ইঁদুর জাতীয় প্রাণীর জন্য। ফসল রক্ষা করতে কীটনাশক অপরিহার্য হলেও অন্যান্য দেশের তুলনায় ভারতে হেক্টর পিছু কীটনাশক ব্যবহারের হার অনেক কম। ভারতে গড়ে প্রতি হেক্টারে ০.৫ কেজি কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। ইউ এস এ তে এই গড় প্রতি হেক্টারে ৭.০ কেজি, ইউরোপে ২.৫ কেজি, জাপানে ১২ কেজি আর কোরিয়ায় ৬.৬ কেজি।”

দেশীয় ফসল রক্ষা শিল্প কৃষকদের শস্তা এবং কার্যকরী কীটনাশক যোগায়। সেই শিল্পক্ষেত্রকে প্রান্তিক করে দিয়ে পি এম বি ২০২০ কৃষকদের --- যাদের বেশিরভাগেরই জমির পরিমাণ সামান্য --- জীবিকার আরো ক্ষতি করতে পারে এবং খাদ্য সুরক্ষাকে বিপন্ন করতে পারে।

কৃষক সমাজ এবং বৃহত্তর সমাজ ও শিল্পক্ষেত্রের স্বার্থ রক্ষা করতে হলে সংসদের ভিতরে এই বিল নিয়ে আরো বিস্তৃত আলোচনা প্রয়োজন। সবচেয়ে ভাল হয় এই বিল সাংসদদের এক সিলেক্ট কমিটির কাছে পাঠালে, যাতে তাঁরা বিলটা গভীরভাবে খতিয়ে দেখতে পারেন এবং কৃষক, ভারতীয় কৃষি ও কীটনাশক শিল্পের প্রয়োজনগুলোর কথা মাথায় রেখে উপযুক্ত অদল বদল করতে পারেন। ভারত যদি কীটনাশকের উৎপাদক ও সরবরাহকারী হিসাবে সারা পৃথিবীতে বিশ্বাসযোগ্য এবং আত্মনির্ভর হতে চায়, তাহলে এ কাজ করতেই হবে। একই সঙ্গে দেশের মধ্যে খাদ্য সুরক্ষার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা এবং কর্মসংস্থান তৈরি করার জন্যও এটা করা দরকার।

ফসল বাঁচাতে কীটনাশকের ভূমিকা উল্লেখ করে নির্মলা পাথরাওয়াল, এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর – ক্রপ কেয়ার ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়া, বলেন: “সি সি এফ আই হল ৫০ এরও বেশি ঐক্যবদ্ধ ভারতীয় প্রস্তুতকারীর সংগঠন। এই সংগঠন ভারতের কৃষি-রসায়ন শিল্পের মূর্ত প্রতীক। আমাদের নীতি হল ফসল উৎপাদনে উন্নতি, আর মাঠে কাজ চলার সময়ে এবং ফসল জমিয়ে রাখার সময়ে কৃষকদের সুরক্ষা। এই ফেডারেশনের একমাত্র উদ্দেশ্য হল কৃষিকাজে লোকসান কমানো, যাতে উৎপাদন বাড়ানো যায়। তা করা গেলে কৃষকের আয় বাড়ে এবং কৃষক সমাজের জীবনযাত্রার মানের উন্নতি ঘটে। সি সি এফ আই সরকার আর এই শিল্পক্ষেত্রের মধ্যে দায়িত্বশীল মধ্যস্থতার কাজ করে। আর সেই কাজ কৃষক, গবেষক, বিজ্ঞানী প্রভৃতি সমস্ত স্তরেই চলে। কর্পোরেট, বাণিজ্য ও চ্যানেল পার্টনার, কৃষক সহ কৃষি-রসায়ন শিল্পের সমস্ত অংশীদারের সুবিধার্থে সরকারী নীতি প্রণয়নে এই সংগঠন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।”

তিনি আরো বলেন, “পি এম বি কৃষি ক্ষেত্রের সংস্কার করার এক গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ দিচ্ছে। এই সংস্কারের ফলে কৃষকদের সমস্যাগুলোর বিজ্ঞানভিত্তিক সমাধানের মাধ্যমে চাষবাসকে দীর্ঘ মেয়াদে আরো লাভজনক করে তোলা যাবে। একটা স্বচ্ছ, স্থিতিশীল এবং দায়িত্বপূর্ণ আইনানুগ ব্যবস্থা তৈরি করা ভারতীয় কৃষক এবং কীটনাশক শিল্পের স্বার্থের পক্ষে ভাল। রেজিস্ট্রেশন কমিটির (আর সি) সিদ্ধান্তগুলোর তদারক করা, পুনর্বিবেচনা করা এবং শক্তভাবে শাসন চালানোর জন্য একটা সুযোগ্য সংস্থা দরকার। পি এম বি র ২৩, ২৪ এবং আর যে প্রাসঙ্গিক ধারাগুলোতে আর সি নিজেই নিজের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে পারবে বলা রয়েছে, সেগুলোর সংশোধন করে এটা সহজেই করা সম্ভব।”

যদি এখনকার চেহারাতেই পি এম বি রাজ্যসভায় পাশ হয়ে যায় তাহলে এর বেশ কিছু ধারা কেবল ভারতীয় কৃষির উপর নয়, কৃষকদের জীবিকার উপরেও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে।

যেমন ২৩ নম্বর সেকশনে ১৯৬৮র আইনে ইতিমধ্যেই রেজিস্ট্রিকৃত কীটনাশকগুলোর আবার রেজিস্ট্রি করার ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু পি এম বি বলছে ঐ রেজিস্ট্রেশন এই বিল আইনে পরিণত হওয়ার পর মাত্র দু বছর পর্যন্ত বৈধ থাকবে। এই সময়ের মধ্যে কীটনাশক প্রস্তুতকারীকে রেজিস্ট্রেশন কমিটির (আর সি) কাছে আবেদন করে নতুন রেজিস্ট্রেশন করাতে হবে। তবেই ঐ দু বছর কেটে যাওয়ার পরেও তারা ঐ পণ্য বানাতে এবং বিক্রি করতে পারবে। এই ধারার কারণে কীটনাশক শিল্পে অনিশ্চয়তা দেখা দেবে এবং কৃষির উপরেও প্রভাব পড়বে। চাষের কাজে প্রয়োজনীয় একাধিক পণ্য হয়ত পাওয়া যাবে না, কারণ হয় আর সি আবার রেজিস্ট্রেশন দিয়ে উঠতে পারেনি অথবা দিতে অস্বীকার করেছে। বরং নতুন আইন অনুযায়ী ১৯৬৮র আইন অনুসারে হওয়া প্রত্যেকটা রেজিস্ট্রেশন কোন সময়সীমা ছাড়াই বরাবরের জন্য বৈধ বলে ঘোষিত হওয়া উচিৎ।

পি এম বি ২০২০র অন্য যে ধারাগুলো কৃষকদের জীবনধারণকে প্রভাবিত করতে পারে সেগুলোর মধ্যে আছে:

· সরকারী সংস্থাগুলোর অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা, যার অপব্যবহার হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। ফলে কৃষকদের জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয় ফসল বাঁচানোর পণ্যের নিয়মিত যোগান বাধা পেতে পারে।

· রেজিস্টার্ড কীটনাশকগুলোর উপর অনবরত পুনর্মূল্যায়ন এবং উৎপাদন বন্ধ করিয়ে দেওয়ার বিপজ্জনক সম্ভাবনা। এর ফলে ফসল বাঁচানোর জন্য প্রয়োজনীয় পণ্যের যোগানে ঘোরতর বাধা পড়তে পারে।

· হঠাৎ কোন কীট পতঙ্গের ব্যাপক আক্রমণ হলে জরুরী ভিত্তিতে নতুন কীটনাশক অনুমোদন করার ব্যবস্থা পি এম বি তে নেই। ফলে সম্প্রতি ভারতের কিছু অঞ্চলে যে পঙ্গপালের ধ্বংসাত্মক আক্রমণ হল, তেমন হলে ফসলের বিপদ হবে। এছাড়া আর্মিওয়ার্ম, বোলওয়ার্মের আক্রমণেও একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।

· যে ধরনের ক্ষতির ক্ষেত্রে কীটনাশক প্রস্তুতকারীদের কিছু করার নেই, সেগুলোর কথা বিবেচনা না করেই পি এম বি তাদের ঘাড়ে ক্ষতির দায় চাপিয়ে দেয়।

· পি এম বি অনুসারে ভারতে ফর্মুলা রেজিস্ট্রেশন করানোর আগে কোন কীটনাশক আমদানীকারকের টেকনিকাল গ্রেড কীটনাশক রেজিস্ট্রি করানোর দরকার নেই। এর ফলে আমদানি করা ফর্মুলা অতিরিক্ত সুবিধা পেয়ে যেতে পারে। তাতে অনিয়ন্ত্রিত, নিম্ন মানের বা অননুমোদিত উৎস থেকে নেওয়া এক্সপায়ার্ড টেকনিকাল গ্রেড কীটনাশক থাকতে পারে।



কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করার একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হল ফসল বাঁচানো, অথচ পি এম বি সেই কাজটাকে এত কঠিন করে দেবে যে পোকামাকড়ের কারণে আর নানারকম রোগে লোকসানের ফলে আয় দ্বিগুণ হওয়া অসম্ভব এক স্বপ্নে পরিণত হবে।

এইসব খামতির কারণে ফসল রক্ষা শিল্প, কৃষক সমাজ এবং বৃহত্তর সমাজের এক বড় অংশ এই বিল নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।