দেশের বাইরে প্রথম যে দেশের মাটিতে পা রেখেছিলেন সুনীল
দেশের বাইরে প্রথম যে দেশের মাটিতে পা রেখেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় -সেই দেশটি হলো ফরাসী দেশ। আমেরিকার মধ্য-পশ্চিমে আয়ওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্য বিভাগের প্রধান অধ্যাপক পল এঙ্গেল পৃথিবীর সব প্রান্তের কবিদের আত্মীয় সম্মেলন ঘটানোর জন্য যে ইন্টারন্যাশনাল রাইটিং প্রোগ্রাম শুরু করেছিলেন সেখানে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ আসে সুনীলের।
এই প্রসঙ্গে সুনীল লিখেছিলেন- “আমার কাছে সেই চিঠি একটা বিরাট লটারি প্রাপ্তির মতন হলেও প্রথমে বেশ কয়েক ঘন্টা আমার খুবই বিমূঢ় অবস্থায় কেটেছিলো। প্রস্তাবটি এমনই অপ্রত্যাশিত যে প্রায় অলীকের পর্যায়ে পড়ে। এত কবি লেখক থাকতে আমার মতন নগণ্য একজনকে ডাকা হলো কেন? আমি অবশ্য নিজেকে নগণ্য মনে করতাম না, তখন সদর্পে কৃত্তিবাস নামে কবিতার সম্পাদনা করছি, বাংলা কবিতা নিয়ে খুব একটা ভাঙচুর করার স্পর্ধা পোষণ করি মনে মনে, তবু সাংসারিক দারিদ্র্যের জন্য বাইরে একটা হীনমন্যতা বোধ কিছুতে কাটিয়ে উঠতে পারি না।”
যাইহোক পরবর্তিতে ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের কয়েকজনকে জানাতে তারা প্রতিনিয়ত উৎসাহ দিতে লাগলেন সুনীলকে। ইতিমধ্যে বিদেশ যাওয়ার অভিজ্ঞতা ছিলও কৃত্তিবাসের শরৎকুমারের- তিনি অনবরত ভরসা দিয়েছিলেন সুনীলকে।
তবে সমস্যা তৈরি হয়েছিলো পাসপোর্ট নিয়ে। সুনীল লিখেছেন- “দিনের পর দিন পাসপোর্ট অফিসে ঘোরাঘুরি করি, ধমক খেয়ে ফিরে আসি। এদিকে পয়লা সেপ্টেম্বরের মধ্যে পৌঁছাতে না পারলে আমন্ত্রনটাই নষ্ট হয়ে যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উজ্জ্বল তারকা নই, নামকরা কোনো পরিবারের সন্তান নই, নিতান্তই এক হেঁজিপেজি এবং নিছক বাংলা কবিতা লিখি, তবু আমাকে বিদেশের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্লেন ভাড়া দিয়ে নিয়ে যাবে, এক বছর থাকতে-খেতে দেবে, এটা যেন পাসপোর্ট অফিসারের কিছুতেই সহ্য হচ্ছিলো না। প্রত্যেকবার হাজার রকম জেরা এবং প্রত্যাখ্যান। রাগের চোটে এক এক সময় মনে হতো ঘুষি মেরে লকটার দাঁত ভেঙে দিই!”
তবে শেষ মুহূর্তে ম্যাজিকের মতন সে কালের এক জাঁদরেল পুলিশ অফিসার দেবী রায়ের দৌলতে পাসপোর্ট এর সমস্যা মেটে। “অগাস্ট মাসের গরমে, গরম স্যুট পড়ে, শু-মোজা পায়ে, গলায় মেরুন টাই বেঁধে, নব কার্তিকের মতন চেহারায় ঘামতে ঘামতে উঠলাম বিমানে।” এভাবে করাচি হয়ে প্যারিসে পৌছালেন সুনীল। প্যারিস বিমানবন্দরের ট্রানজিট লাউঞ্জে বিশ্রাম করে তারপর আবার যাত্রা। কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো এখানে। সুনীলকে ছেড়েই প্লেন যাত্রা করেছে আমেরিকার পথে।
ফরাসি ভাষা না জানার খেসারত দিতে হয়েছিলো সেদিন। সুনীল নিজেই জানিয়েছেন সে কথা- “আমি কবিতা নিয়ে মগ্ন হয়ে আছি, কত সময় কেটে গেছে জানি না, হঠাৎ মাইক্রোফোনে কিরকম যেন একটা উদ্ভট শুব্দ শুনতে পেলাম। গ্যাঁগে! প্যাডিই-ই-ই… ছুনিল গ্যাঁগো প্যাডি-ই…। আরে এটা আমার নাম নাকি! আমি ছুটে কাউন্টারে যেতেই একজন উত্তেজিত ভাবে ফরাসীতে কী যেন বলতে লাগলো, আমি যত বলি যে জ্য ন পর্ল পা ফ্রাঁসে, আমি ফরাসী ভাষা জানি না, তবু সে থামে না। শেষ পর্যন্ত একজন ইংরেজি জানা লোক এসে বললো, তুমি এতক্ষণ কী করছিলে? ঐ দ্যাখো তোমার প্লেন ছেড়ে যাচ্ছে। আমি সেদিকে দৌড় লাগাতে যেতেই সে আমার হাত চেপে ধরে বললো, সিঁড়ি সরিয়ে নেওয়া হয়ে গেছে দেখছো না? তোমার আর ঐ প্লেনে যাওয়া হবে না!”
আঁতকে উঠলেন সুনীল। ঐ বিমানে রয়েছে সুনীলের স্যুটকেস। পকেটে মাত্র আট ডলার। একদম অজানা প্যারিসে কি করবে সে!
যদিও সুনীলের ব্যাকুলতা দেখে তিন-চারজন বিমানকর্মী ঘিরে ধরে বোঝানোর চেষ্টা করে ভয়ের কিছু নেই, ঘন্টা চারেক বাদে অন্য এয়ার লাইনসের এক বিমানে তাকে তুলে দেওয়া হবে আর স্যুটকেস নিউ ইয়র্কে অপেক্ষা করবে। আর হলও তাই । নিউইয়র্কে পৌঁছে খিজে পেলেন নিজের স্যুটকেস।
নিউইয়র্ক থেকে বিমান বদলে শিকাগো। শিকাগোতে রাত্রিবাস করে পরের দিন ভোরবেলা ছোট প্লেনে করে আয়ওয়ারের উদ্দেশে রওনা দিলেন। সুনীল লিখলেন সেই বর্ণনা- “বাগডোগরা কিংবা তেজপুরের মতন ছোট্ট এয়ারপোর্ট আয়ওয়া সিটির। রানওয়ের ওপরেই দাঁড়িয়ে ছিলেন পোল এঞ্জেল। আমি নামতেই তিনি দু’হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। সেই উষ্ণতায় বুক ভরে গিয়েছিল।”
0 মন্তব্যসমূহ
Thank you so much for your kindness and support. Your generosity means the world to me. 😊