নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর চোখে স্বদেশপ্রেমিক শরৎচন্দ্র 




শরৎচন্দ্র বাঙালির প্রাণের মানুষ । সমাজের হিংস্র কশাঘাতে যারা আহত হয়েছেন বারংবার তাদের জন্যই শরৎচন্দ্রের দরদ ছিলো বেশী। তাই তো তিনি নিজেই দৃপ্তকন্ঠে বলতে পেরেছিলেন-
"সংসারে যারা শুধু দিলে, পেলে না কিছুই, যারা দুর্বল, উৎপীড়িত, মানুষ হয়েও মানুষ যাদের চোখের জলের কখনো হিসেব নিলে না, নিরূপায় দুখময় জীবনে যারা কোনোদিন ভেবেই পেলে না সমস্ত থেকেও কেন তাদের কিছুতেই অধিকার নেই-এদের কাছেও কি আমার ঋণ কম; এদের বেদনাই দিলে আমার মুখ খুলে, এরাই পাঠালে আমাকে মানুষের কাছে মানুষের নালিশ জানাতে। তাদের প্রতি কতো দেখেছি অবিচার, কতো দেখেছি কুবিচার, কতো দেখেছি নির্বিচারে দুঃসহ সুবিচার তাই আমার কারবার শুধু এদেরই নিয়ে।" 

তবে শুধু সাহিত্যিক রূপেই তিনি মানুষের পাশে কিন্তু ছিলেন না। দেশ এবং দেশবাসীর সঙ্কটে তিনি  কলম ছেড়ে চরকা হাতে নিতেও পিছপা হননি। 


আজ তাঁর জন্মদিনে দেশপ্রেমিক শরৎচন্দ্রকে জানতে আর এক দেশপ্রেমিক সুভাষচন্দ্র বোস এর কথা মনে পড়ে। নেতাজীর চোখে শরৎচন্দ্রের যে দেশপ্রেমিকের রূপ উঠে এসেছে তা নিখুঁত সত্য। আসুন যেনে নেই শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে কীভাবে দেখেছেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস।
 

স্বদেশপ্রেমিক শরৎচন্দ্র
সুভাষচন্দ্র বসু

শরৎচন্দ্র বাঙ্গালা সাহিত্যের যে আসনে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন, দীর্ঘকাল তাহা শূন্য থাকিবে। বাঙ্গালায় এমন কোনাে পরিবার নাই যেখানকার আবালবৃদ্ধ নরনারীর নিকট তিনি পরিচিত ও সমাদৃত নহেন। 

কিন্তু কেবলমাত্র অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিককে হারাইয়াই যে আমরা শােকাভিভূত হইয়াছি তাহা নহে, শােকপ্রকাশের অপর কারণ—তিনি ছিলেন কংগ্রেসের একটি শক্তিস্তম্ভে। অসহযােগ আন্দোলনের প্রথম হইতেই তিনি বাঙ্গালার কংগ্রেসে যােগদান করেন। তাঁহার শ্রেষ্ঠ দান তিনি হাওড়া জেলায় বিতরণ করিয়াছেন, সেখানে তাহার অভাব বিশেষভাবেই অনুভূত হইবে। | তাঁহার সহিত আমার অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধত্ব ছিল। আমার বেদনা আজ অতি গভীর।....।

শরৎচন্দ্র শুধু সাহিত্যিক ছিলেন না, রাজনীতিক্ষেত্রেও তাঁহার দান ছিল এবং সেই সুবাদেই ১৯২১ খ্রীষ্টাব্দে শরৎচন্দ্রের সহিত আমার প্রথম পরিচয় ঘটিয়াছিল।

মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারতব্যাপী অসহযােগ আন্দোলন প্রবর্তিত হইলে শরৎচন্দ্র এই আন্দোলনে যােগদান করেন। কলিকাতায় এই সময়ে যে জাতীয় বিদ্যাপীঠ প্রতিষ্ঠিত হয় শরৎচন্দ্র তাহার অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন। এই সময়ের একদিনের কথা আমার মনে আছে ; একজন প্রসিদ্ধ সাহিত্যিক শরৎচন্দ্রকে বলিলেন-“কলম ছাড়িয়া রাজনীতিকের দলে ভিড়িয়া পড়া সাহিত্যিকের কর্তব্য নহে।” শরৎচন্দ্র তাহাতে হাসিয়া বলেন-“আমি কিন্তু কিছুদিনের জন্য কলম ছাড়িয়া চরকাই ধরিয়াছি।” 

শরৎচন্দ্রের এই উক্তির অর্থ ছিল এই যে, দেশমাতা যখন বিপন্না, তখন ব্যক্তিগত সমুদয় চিন্তা ও অভ্যাস পরিত্যাগ করিয়া তাঁহার রক্ষায় অবতীর্ণ হওয়াই সন্তানের কর্তব্য। দেশমাতৃকার প্রতি আন্তরিক প্রীতি তাঁহার আমরণ বিদ্যমান ছিল। বহু বৎসর যাবৎ তিনি নিখিল ভারত রাষ্ট্রীয় সমিতির ও বঙ্গীয় প্রাদেশিক রাষ্ট্রীয় সমিতির সদস্য এবং হাওড়া জেলা কংগ্রেস কমিটির সভাপতি ছিলেন। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সহিত তাহার ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ ছিল । লাজুক ছিলেন বলিয়া তিনি সভা-সমিতিতে বড় একটা যােগ দেন নাই বটে, কিন্তু সংশ্লিষ্ট যুবকেরা তাঁহার নিকট হইতে অনেক প্রেরণা লাভ করিয়াছে। স্বদেশপ্রেমিক শরৎচন্দ্রের এই দিকটার পরিচয় আজকাল তেমন জানে না। কেমন, জানাে তাঁহার মন ছিল চিরসবুজ। তরুণ বাংলার আশা আকাঙক্ষার প্রতি তাঁহার পূর্ণ সহানুভূতি ছিল । যতদিন তিনি জীবিত ছিলেন, সরকার ও পুলিস তাঁহার প্রতি তীক্ষ দৃষ্টি রাখিত।  

তাঁহার “পথের দাবী” নামক বিখ্যাত গ্রন্থ বাজেয়াপ্ত হইয়াছিল—তিনি যে কারারুদ্ধ হন নাই, ইহাই বিস্ময়ের বিষয়। কারাবাসজনিত অভিজ্ঞতা লাভ করিলে সেই অভিজ্ঞতা দ্বারা তাঁহার সাহিত্য আরও সমৃদ্ধ হইতে পারিত। সমাজে যাহারা বর্জিত ও উপদ্রুত, তাঁহাদের প্রতি সমবেদনাই শরৎ-সাহিত্যের সর্বাপেক্ষা বড় প্রেরণা। নিজের জীবন তিনি দুঃখ-দৈন্য ও পরীক্ষার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করিয়াছেন বলিয়াই এই প্রেরণা লাভ করিয়াছেন। জীবনের এই কঠোর পরীক্ষায় যাঁহারা মুহ্যমান হইয়া পড়েন, শরৎচন্দ্র তাঁহাদের দলে ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন বিদ্রোহী, তাঁহার সাহিত্যের মধ্য দিয়ে জাতির যুব-সমাজের নিকটে এই বিদ্রোহের বাণীই তিনি ছড়াইয়াছেন। সত্যের প্রতি অটুট নিষ্ঠা তাঁহার সাহিত্যের সত্যপ্রচারের প্রেরণাই যােগাইয়াছে।  

আমাদের দেশে বিশেষভাবে বাংলায় হাস্যরসের বড় অভাব। শরৎ-সাহিত্যে এই হাস্যরসের প্রাধান্য দেখা যায়। দুঃখ-দৈন্য তাঁহাকে বিচলিত করিতে পারিত না। বলিয়াই ঘােরতর দুর্দশা বর্ণনাকালেও তিনি হাস্যরসের নিঝর বহাইয়াছেন। এতগুলি গুণ একজন মানুষের সচরাচর সম্ভব হয় না—একাধারে তিনি ছিলেন একজন আদর্শ লেখক, আদর্শ দেশপ্রেমিক ও সর্বোপরি আদর্শ মানব। 


লেখাটি বিশ্বনাথ দে সম্পাদিত শরৎ স্মৃতি  থেকে সংকলিত।