করোনার দাপটে সারা বিশ্ব কুপোকাত। আমেরিকা, ইতালি, ভারতের মতো দেশও করোনাকে এখনও বাগে আনতে পারেনি। বিজ্ঞানীরাও দিন-রাত চেষ্টা করে প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে পারছে না। এর মাঝেই একের পর এক নানান বৈশিষ্ট্যগত পরিবর্তন দেখা গেছে এই ভাইরাসে বলেই জানিয়েছেন গবেষকরা। 

করোনার ভয়াল থাবায় সকলেই করোনার উপসর্গ সম্পর্কে অবগত। জ্বর, কাশি, গলা ব্যাথাসহ একাধিক উপসর্গ দেখা মিললেই  করোনা সংক্রমণ অনুমান করা হয়। কিন্তু, উঠে এসেছে এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। এমন কিছু মানুষও আছে যাদের দেহে কোনও উপসর্গই দেখা দেয় না। এমনকি, এড়া জানেও না তাঁদের শরীরে করোনা ভাইরাস আছে এমনকি নীরবে ছড়িয়ে দিয়েও চলছে। 

বিজ্ঞানীরা মনে করছে, এরকম বিনা উপসর্গ নিয়ে বহন করা ও নীরবে বিস্তারকারী কতজন আছে তা জানা এখন খুব জরুরী। বিনা উপসর্গে ও নীরবে বিস্তার করার মতো চাঞ্চল্যকর তথ্যও উঠে এসেছে।

বিবিসি তে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে ১৯ জানুয়ারি সিঙ্গাপুরের দ্য লাইফ চার্চ এ্যান্ড মিশন নামের গির্জাতে প্রার্থনায় উপস্থিত ছিলেন এক প্রৌঢ় দম্পতি। ওই দম্পতিটির দু’জনেরই বয়স ৫৬। কোন উপসর্গ বা স্বাস্থ্য সমস্যাও ছিল না তাঁদের। ফলে গির্জার কারোরই তাদের নিয়ে অন্য কিছু ভাবার কোন কারণ ছিল না। করোনা সংক্রমণের কেন্দ্রবিন্দু চিনের উহান থেকে তাঁরা সিঙ্গাপুরে এসেছিলেন। করোনা উপসর্গ না থাকায় তেমন কোনও চিন্তিত ছিল না কেউই। 

চার্চ থেকে চলে যাবার তিনদিন পর মহিলা ও তাঁর দুদিন পর মহিলার স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়ে। এক সপ্তাহের মধ্যে সিঙ্গাপুরের তিনজন স্থানীয় লোক অসুস্থ হয়ে পড়লেন। কোথা থেকে কীভাবে তারা সংক্রমিত হলেন – কেউ বুঝতে পারছিল না। সিঙ্গাপুরে করেনাভাইরাস বিস্তারের সেখান থেকেই সূচনা।

সিঙ্গাপুরের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংক্রামক রোগ বিভাগের প্রধান ভারনন লী বলেন, ‍“আমরা একেবারেই বোকা বনে গিয়েছিলাম। যাদের দেহে রোগের কোন লক্ষণ নেই , তারা কী করে অন্যকে সংক্রমিত করতে পারে?”

ড. লী তখন পুলিশ এবং রোগ সংক্রমণ বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কনট্যাক্ট ট্রেসিং করা শুরু করেন। যার মাধ্যমে কীভাবে সংক্রমণ ছড়িয়েছে তা জানা যায় এবং রোগ বিস্তার ঠেকানো যায়। 

তদন্তকারী দল সেই দিনের প্রার্থনায় সভায় উপস্থিত হওয়া ১৪২জনকে খুঁজে বের করলেন ১৯১ জনের সঙ্গে কথা বলে। যে দু‌’জন সংক্রমিত হয়েছিলেন তাঁরা এই প্রার্থনাতেই ছিলেন। 

ডঃ লী বলেছেন- ‍“হয়তো তারা কথা বলেছিলেন, বা পরস্পরকে সম্ভাষণ করেছিলেন – যা গির্জায় প্রার্থনার সময় খুবই স্বাভাবিক ঘটনা‍” ।  “সেই চীনা দম্পতির দেহে তো সংক্রমণের কোন লক্ষণ ছিল না। তাহলে তারা কিভাবে ভাইরাস ছড়ালেন ?”

কিন্তু, আশ্চর্যের বিষয় তৃতীয় যে মহিলা সংক্রমিত হয়েছেন তিনি সেই প্রার্থনায় উপস্থিত ছিলেন না। অন্য একটি প্রার্থনায় উপস্থিত ছিলেন তিনি। সিসিটিভি ফুটেজ থেকে জানা যায়, চীনা দম্পতি গির্জা থেকে চলে যাবার পর তারা যে চেয়ারে বসেছিলেন, কয়েক ঘন্টা পর সেই চেয়ারেই এসে বসেছিলেন আক্রান্ত মহিলাটি। 

চিনা দম্পতি নিজের অজান্তেই বিস্তার করে চলছিল করোনা ভাইরাস। কিন্তু কোনও অসুস্থতা ছিল না বা কোন উপসর্গ ছিল না।হয়তো তাদের হাতে ভাইরাস লেগে ছিল, বা হয়তো তাদের শ্বাস-প্রশ্বাস থেকে এটা ছড়িয়েছে। ঠিক কী ঘটেছে তা স্পষ্ট নয় – কিন্তু এর তাৎপর্য ছিল বিশাল।

কোন উপসর্গ না থাকলেও নীরবে এবং অদৃশ্যভাবে এ ভাইরাস ছড়াতে পারে।

উপসর্গ দেখা দেবার আগেই রোগ বিস্তার ঘটে যাচ্ছে একে বলে প্রি-সিম্পটম্যাটিক ট্রান্সমিশন । করোনাভাইরাস কারো শরীরে ঢোকার পর ২৪ থেকে ৪৮ ঘন্টা পর্যন্ত সময়টায় - কোন লক্ষণ দেখা না দিলেও - আক্রান্ত ব্যক্তি ‌অত্যন্ত সংক্রামক‌ বা হয়তো সবচাইতে বেশি সংক্রামক হতে পারেন । এব্যাপারে সচেতন হতে হবে উপসর্গ দেখা দিলেই সংস্পর্শে আসা মানুষদের সচেতন করে দিতে হবে। 

কিন্তু কিভাবে ছড়াচ্ছে এই ভাইরাস তা এখনও স্পষ্ট নয়। 

অনেক গবেষক মনে করছেন কাশী বা হাঁচির মাধ্যমে বেরিয়ে আসা ড্রপলেট বা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলকণার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে এই ভাইরাস। কিন্তু যাদের ক্ষেত্রে উপসর্গ, কাশি দেখা দেয়নি তাঁদের ক্ষেত্রে কিভাবে ছড়ানো সম্ভব? 

অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছে কথা বলার সময় বা শ্বাস- প্রশ্বাসের সাথে বেরিয়ে আসা ড্রপলেটের মাধ্যমেই এই ভাইরাস ছড়াতে পারে। কাজেই কাছাকাছি কেউ থাকলে – বিশেষত ঘরের ভেতরে - খুব সহজেই সংক্রমিত হতে পারে।

সংক্রমণের এর একটা বিশেষ উপায় স্পর্শ। কারো হাতে ভাইরাস লেগে থাকলে তিনি যদি আরেকজনের হাত ধরেন, বা দরজার হাতল, টেবিল-চেয়ার বা অন্য কিছু স্পর্শ করেন – তার মাধ্যমেও এটা ছড়াতে পারে।

কিছু লোকের দেহে ভাইরাস সংক্রমণ ঘটেছে কিন্তু তার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না – এই রহস্যময় ব্যাপারটা কীভাবে ঘটে তার কোন সুনির্দিষ্ট উত্তর বিজ্ঞানীরা দিতে পারছেন না।

ব্রিটেনের কেম্ব্রিজের এ্যাডেনব্রুক হাসপাতালের নার্স এ্যামেলিয়া পাওয়েল এমনই একজন এ্যাসিম্পটম্যাটিক অর্থাৎ তার দেহে ভাইরাস উপস্থিত থাকলেও এর কোন লক্ষণ ছিল না।

তিনি বলছিলেন, ‍“আমি হাসপাতালের রোগীদের দেখে চিন্তিত হতাম যে কোন দিন আমারও এটা হতে পারে কিনা। কিন্তু আমি নিজে কোন কিছুই অনুভব করিনি, আমি স্বাভাকিভাবেই খাওয়াদাওয়া, ঘুম, ব্যায়াম করছিলাম। “

ঘটনাচক্রে হাসপাতালের স্টাফদের এক জরিপে অংশ নেবার কারণে তার করোনাভাইরাস টেস্ট করাতে হয়। পরীক্ষায় করোনাভাইরাস পজিটিভ ধরা পড়ার পর তাকে কাজ ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে আইসোলেশনে থাকতে হয়।

জানা গেছে, প্রতি এক হাজার লোকের মধ্যে প্রায় ৩ শতাংশ লোকের দেহে করোনাভাইরাস থাকলেও তার কোন উপসর্গ দেখা যায় না।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কার্ল হেনেগ্যান জানান, এই সংখ্যা নির্ণয় করার মতো নির্ভরযোগ্য কোনও উপায় নেই। তিনি করোনাভাইরাস সংক্রমণ সংক্রান্ত ২১টি গবেষণা প্রকল্পের উপাত্ত পরীক্ষা করে দেখেছেন। তবে, উপসর্গবিহীন কোভিড-১৯ ভাইরাস বহনকারীর অনুপাত ৫ শতাংশ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে বলে জানান তিনি।

ব্রিটেনের আর্লহ্যাম ইনস্টিটিউট এর প্রধান অধ্যাপক নিল হলের মতে, উপসর্গবিহীন কোভিড বহনকারীরা হচ্ছেন এই মহামারির ‘ডার্ক ম্যাটার। হয়তো তারাই এ মহামারি জিইয়ে রেখেছে।

ক্যালিফোর্নিয়ার একদল বিজ্ঞানী বলছেন, মহামারির ব্যবস্থাপনার ওপর এ ধরণের উপসর্গবিহীন সংক্রমণের ঝুঁকি এক গভীর প্রভাব ফেলছে।

তবে, বর্তমান পরিস্থিতিতে বহু দেশ লক ডাউন শিথিল করছে ফলে এই অদৃশ্য বিস্তারকারীদের নিয়ন্ত্রন করা বেশ চাপের বলেই মনে করছেন তাঁরা। তবে, প্রতিরক্ষার জন্য অবশ্যই মাস্ক পড়া ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা উচিত। হয়তো এগুলোতে ভাইরাস বিস্তার পুরোপুরি ঠেকানো সম্ভব হবে না, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।

credit: BBC