একে কি বাঁচা বলে না এভাবে বাঁচা যায়?-করোনা মহামারীতে পার্শ্বশিক্ষকদের করুণ অবস্থা


একদিকে করোনা অপরদিকে আম্ফান। বিধ্বস্ত বাংলায় সঙ্কটে অর্থনীতি। করোনা প্রতিরোধে ঘোষিত লকডাউনে কাজ হারিয়েছেন অনেকেই। বন্ধ হয়েছে কলকারখানা থেকে শিক্ষাকেন্দ্র । কেউ ভালো নেই এর সময় পার্শ্বশিক্ষকদের অবস্থা আরও সঙ্কটপূর্ণ হয়ে উঠেছে । বেতন বন্ধ না হলেও অনেকের টিউশন বা অন্যান্য কাজকর্ম বন্ধ থাকায় সামান্য বেতনে দিনগুজরান অসম্ভব হয়ে উঠেছে। ফলে দেখা যাচ্ছে রাজ্যের পার্শ্ব শিক্ষকদের মাথায় ইট নিয়ে রাজমিস্ত্রির কাজ করতে কিংবা বাজারে শাক বিক্রি করতে।

গত ১১ই নভেম্বর, ২০১৯ তারিখ থেকে কলকাতার বিকাশ ভবনের সামনে রাজ্যের পার্শ্ব শিক্ষকরা অনির্দিষ্টকালের অবস্থান এবং ১৫ই নভেম্বর থেকে আমরন অনশনে বসেছিলেন। গত ১১ই ডিসেম্বর,২০১৯ এ রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় পার্শ্ব শিক্ষকদের সংগঠনের সাথে তাদের দাবিদাওয়া নিয়ে কলকাতার বিকাশ ভবনে বৈঠক করেন। সেই বৈঠকে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে সদর্থক আলোচনা হয়েছিল। সেই দাবি করেছিলেন বৈঠকে উপস্থিত পার্শ্ব শিক্ষকদের সংগঠনগুলির প্রতিনিধিরা। শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পরদিনই ১২ই ডিসেম্বর পার্শ্ব শিক্ষকরা তাদের ৩২দিনের অবস্থান ও ২৮দিনের অনশন আন্দোলন স্থগিত করেছিলেন। বৈঠকে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে পার্শ্ব শিক্ষক সংগঠনগুলির যে সদর্থক আলোচনা হয়েছিল তার ইঙ্গিত মিলেছে সংগঠনের পর থেকে।




বৈঠক শেষে পার্শ্ব শিক্ষক ঐক্যমঞ্চের যুগ্ম আহবায়ক শিক্ষক ভগীরথ ঘোষ জানিয়েছিলেন, "শিক্ষামন্ত্রীর সাথে তাদের সদর্থক আলোচনা হয়েছে। তার জন্য আমরা সংগঠনের পক্ষ থেকে সরকারকে তিন মাস সময় দিয়ে আন্দোলন স্থগিত করেছি। আমরা আশাবাদী, শিক্ষামন্ত্রী আমাদের দাবিগুলো নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করবেন। দাবিগুলো বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করবেন এবং নতুন বছরের মার্চ মাসের মধ্যে আমরা একটা ভালো খবর আশা করছি।" সাথে তিনি আরও বলেছিলেন "তিন মাসের মধ্যে যদি রাজ্য সরকার আমাদের দাবি না পূর্ণ করেন তাহলে আমরা আবার আন্দোলনের পথে যাব। আমরা আন্দোলন প্রত্যাহার করিনি। তিন মাসের জন্য স্থগিত করেছি।"

তিনমাসের মধ্যেই  বেতন কাঠামো ঘোষণা না হলেও  বিজ্ঞপ্তি জারি করে মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় পরীক্ষাকেন্দ্রে ইনিভিজিলেটরের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ভেনু সুপারভাইজারদের নির্দেশ দেওয়া হয় এবারের মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় পার্শ্বশিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য। যথাযথ ভাবে সেই দায়িত্বও পালন করেন তারা। 


বর্তমানে প্রায় ৪৮,০০০ পার্শ্বশিক্ষক কর্মরত আছেন, কিন্তু প্রায় ১৫ বছরের অধিকাল কাজে নিযুক্ত থাকার পরও NCTE rule অনুযায়ী পার্শ শিক্ষকরা সকলেই উপযুক্ত যােগ্যতা (ডি.এল.এড.) অর্জন করলেও এখনও পর্যন্ত তাদের পূর্ণ শিক্ষকের মর্যাদা প্রদান করা হয় না, পারিশ্রমিক বা ভাতা প্রদান করা হয়। অথচ, PAB (Project Approval Board) এ বেতন কাঠামাের উল্লেখ থাকলেও তা প্রদান করার ব্যবস্থা এখনাে পর্যন্ত শিক্ষা দফতর গ্রহণ করেনি। 

এছাড়াও বেশ কিছু সুযােগ সুবিধা থেকেও পার্শ্বশিক্ষকরা বঞ্চিত বলে ঐক্যমঞ্চের পক্ষথেকে জানানো হয়েছে। তারা পারিশ্রমিক হিসাবে যা পান,তা বর্তমানে মূল্য সূচকের অনেক নীচে। তার দ্বারা জীবন নির্বাহ করা সম্ভব নয়। এর ফলে গত ৩-৪ বছরে শতাধিক পার্শ্ব শিক্ষক শিক্ষিকা বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করেছেন, নয়ত দরিদ্র্যের সঙ্গে লড়াইয়ে হার মেনে আত্মহত্যা করেছেন বলেও সংগঠন সূত্রের খবর।

ঐক্যমঞ্চের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে - বর্তমানে একদিকে ১১৫ জন পার্শ্বশিক্ষক চাকরীকালীন অবস্থায় মারা গেছেন, অথচ তাঁদের পরিবারের দিকে সরকার ফিরেও তাকাননি । অন্যদিকে ২০১৫ থেকে পি এফ কাটা শুরু হয়েছে, ফলে ২০২৫এর অক্টোবরের আগে যারা অবসর নেবেন তারা পেনশন থেকেও বঞ্চিত হবেন। এই বিষয়ে উচ্চ আদালত রায় দিলেও রাজ্য কোন পদক্ষেপ নেয়নি। এই দুটি বিষয় বর্তমানে জ্বলন্ত সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছেও বলে জানান। 

পার্শ্বশিক্ষক ঐক্যমঞ্চের দক্ষিন ২৪ পরগনার যুগ্ম আহ্বায়ক- সুজিত বরণ বেরা জানান- "সরকারি অবহেলার শিকার আজ প্যারাটিচাররা ۔ নেই সমাজে সুস্থভাবে ও স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার রসদ পরিবারকে নিয়ে ۔ '২৫ সালের অক্টবর মাসের আগেই এক বড়ো অংশের শিক্ষক অবসর নেবেন প্রায় শূন্য হাতে ۔ রাজ্য সরকার প্যারাটিচারদের PF চাকরির শুরু থেকে না কাটানোয় EPFO র অবসরকালীন সামান্য পেনশনও তারা পাবেন না ۔ সেই কারণে তাদের চাকরির মেয়াদ ৬৫ বৎসর করার দাবিও সরকার মানেনি ۔এদিকে "আম্ফান"-এ বিধস্ত প্যারাটিচারদের বাড়ি ۔ আধপেটা খেয়ে কাটাচ্ছে পরিবারগুলি ۔ একশো পনেরোটি পরিবার আজ অসহায় ۔ পরিবারগুলির একমাত্র উপার্জনশীল প্যারাটিচারের চাকরিরত অবস্থায় মৃত্যুর কারণে তাদের পোষ্যদেরও চাকরি দেওয়ার নিয়ম মানেনি সরকার ۔একে কি বাঁচা বলে না এভাবে বাঁচা যায় !"


গত ১৬ জুন ঐক্যমঞ্চের পক্ষ থেকে শিক্ষামন্ত্রীর হাতে ৫০ হাজার টাকার করোনা ও আম্ফান এর ত্রাণ হিসাবে তুলে দেন। সেই সাথে বেতন কাঠামো সহ একাধিক দাবী সহ একটি দাবীপত্র শিক্ষামন্ত্রীর হাতে তুলে দেন।  আম্ফানে অনেক পার্শ্বশিক্ষকদের বাড়িঘর ভেঙ্গে গেছ, শিক্ষামন্ত্রী যাতে এই দিকে বিশেষ দৃষ্টি যাতে দেন তারও আবেদন জানানো হয়।

শিক্ষামন্ত্রী এদিন জানান- বর্তমান করোনা এবং মহামারী বিধ্বস্ত অবস্থা স্থিতীশীল হলেই পার্শ্বশিক্ষকদের দিকে দৃষ্টি দেবেন।

তবে নির্দিষ্ট ভাবে কোন পজিটিভ   বিষয় এদিন শিক্ষামন্ত্রীর সাথে দেখা করে উঠে না আসায় কার্যত হতাশ হয়ে পড়েছেন পার্শ্বশিক্ষকরা। এখন দেখার আগামী দিনে পার্শ্বশিক্ষক ঐক্যমঞ্চ কোন পথে হাটেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ