দুখু মিয়া কবি




রবীন বসু:

দুখু মিয়া কবি l আমাদের কাজী নজরুল ইসলামl আদ্যন্ত দুখী এক পরিবারে জন্মেছিলেনl সম্বল ছিল একটা বাঁশের বাঁশিl খিদে ভুলতে তাতেই সুর তুলতেনl মধ্যদুপুর অতিক্রান্ত বিকেলের বাতাস সে সুর বয়ে নিয়ে যেত বহুদূরl ঘাট থেকে ঘাটে, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরেl


একদিন সেই বাঁশিকে সম্বল করে ঢুকে পড়লেন লেটোর যাত্রাদলেl শুরু হল ভ্রাম্যমান জীবনl জনপদ মুখরিত হল তাঁর বাঁশির সুরেl পালার কাহিনী থেকে জীবনের পাঠ শিখে নিলেনl শুরু হল স্ব-শিক্ষার ভিত্তিস্থাপনl পরে নিজের চেষ্টায় আরবি, আর ফারসি শিখেছিলেন করাচি সেনানিবাসে এক পাঞ্জাবী মেজরের কাছেl নিজেই ব্যঙ্গ করে লিখেছেন একসময়—

‘বিলেত ফেরনি?’ প্রবাসী-বন্ধু ক’ন্, ‘এই তব বিদ্যে ছি !’

ছি! ছিল তাঁর সারাটা জীবনl হিন্দুরা বলেছেন ‘নেড়ে’, মুসলমানরা বলেছেন ‘কাফের’l অথচ তাঁর মত উদার সর্ব-মানবিক সংস্কারমুক্ত সত্যিকার সাম্যবাদী মানুষ বিশ শতকে কমই জন্মেছেনl

“গাহি সাম্যের গান

মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান !”


নারী-পুরুষে সমানাধিকার চেয়েছিলেনl “আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোন ভেদাভেদ নাই !”


কুলি-মজুর, শ্রমিক, চাষী সবাইকে শোষিত মানুষ হিসেবে দেখেছিলেনl তাদের শোষণের অবসান চেয়েছিলেনl


“প্রার্থনা করো—যারা কেড়ে খায় তেত্রিশকোটী মুখের গ্রাস / যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ !”


সর্বহারা মানুষের দুঃখে প্রাণ কাঁদতl কেননা নিজেও তো ছিলেন এক দুঃখী বঞ্চিত আর ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষl সখেদে বলেছিলেন, “আমি কবি হতে আসিনি, শিল্পী হতে আসিনি; আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলামl পেলাম না বলে নীরব অভিমানে এই প্রেমহীন পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিলামl” অদ্ভুত সমাপতনl এর পরই কবি চিরমূক পৃথিবীতে চলে গেলেনl


আমার কাছে তাই নজরুলের বিদ্রোহী কবি-সত্তা, তাঁর স্বাধীনতা সংগ্রামী সত্তা, সুরকার সত্তার চেয়ে প্রেমিক সত্তা বেশি আদরেরl ধূমকেতুর কবির অগ্নি-বীণার ঝংকারের চেয়ে ব্যক্তি-কবির নীরব অশ্রুমোচন বেশি দামি বলে মনে হয়l আজীবন দুঃখের সঙ্গে লড়েছেনl আত্মভোলা সংগীত-পাগল কবিকে এক বোতল সুরা আর এক ডিব্বা পান দিয়ে সারাদিন ধরে গান লেখানো, সুর দেওয়া, আবার সারারাত ধরে সেই গান শিল্পীর গলায় তুলে দেওয়ার মত শ্রমসাধ্য মহড়াও দিতে হয়েছে গ্রামোফোন কোম্পানীর কর্তাদের কথায়l


অসুস্থ পক্ষাঘাতগ্রস্ত স্ত্রী প্রমীলাদেবীর চিকিৎসার টাকা জোগাড় করতে কবি যখন দিশেহারা, তখন খুব কম টাকায় সমস্ত বই ও গানের কপি রাইট কিনে নিয়ে ছিলেন ডি এম লাইব্রেরির মালিকl স্ত্রীর সুস্থতা তখন তাঁর কাছে একমাত্র কাম্য ছিল l আমরা দেখলাম এক চিরকালীন প্রেমিক নজরুলকেl


সুন্দরের পূজারি ছিলেন তিনিl সত্য আর ন্যায়ের সাধক l আকাশের মত উদার আর নির্মলl ঠিক যেন আর এক লালনl জাতিভেদ, বর্ণভেদ, উঁচুনীচু এসব তিনি মানতেন না l নারী-পুরুষ ভেদ করতেন নাl খোদা ভগবান সব তাঁর কাছে একাকার। লিখেছেন--

“শাস্ত্র না ঘেঁটে ডুব দাও সখা সত্য সিন্ধু জলে !”


সারাটা জীবন দুঃখের সাথে লড়াই করে শেষে বাক্যহারা নীরব হল বাঁশিl সুর কিন্তু হারালো না হাজার হাজার কবিতা আর গানে সে সুর অক্ষয় করে গেলেন l


বড় ভালোবাসতেন রবীন্দ্রনাথ এই দামাল কবিকেl বুকে আগলে রাখতে চেয়েছিলেনl কিন্তু বড়ই চঞ্চল আর সুদূরের পিয়সী ছিলেন নজরুলl আজন্ম বোহেমিয়ান, তাকে বাঁধবে কে? তাঁর কবিতার ছন্দে পাই কবির সেই উন্মত্ত দামাল প্রকৃতির ছোঁয়াl এমন মানবিক, এমন সংস্কারমুক্ত সুরেলা কবি রবীন্দ্রনাথের পরেই তিনিl


তাই তিনি যেমন বিদ্রোহের, প্রতিবাদের, ঔদ্ধত্য আর প্রবল ভাঙনের কবিl তেমনই প্রেমের কবি, কাঙাল কবি, সুন্দর আর সত্যের কবি, ফুল আর গুলবাগিচার কবিl আমাদের নজরুল দুখু মিয়া কবি!