শতবর্ষে রামানুজন 


রামানুজন,
শতবর্ষে রামানুজন 
পার্থ প্রতিম পাল

ভারতবর্ষের গণিত ইতিহাসের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র রামানুজন। জন্ম ১৮৮৭ এর ২২'শে ডিসেম্বর, তৎকালীন মাদ্রাজের কুম্ভকোনমে। তামিল নামে সাধারণত পদবি থাকে না, নামের একটি অংশ বাবার থেকে পাওয়া, অন্য অংশটি নিজের। এক্ষেত্রে বাবার অংশ শ্রীনিবাস, এবং নিজের নাম রামানুজন, পারিবারিক পদবী আয়েঙ্গার, পুরো নাম "শ্রীনিবাস রামানুজন আয়েঙ্গার"। কোমলতাম্মল-শ্রীনিবাসে'র বড় ছেলে ছিলেন রামানুজন। ছেলেবেলা থেকেই দারিদ্র্য, মহামারীর সাথে সংগ্রাম করে বড় হয়েছেন। কলেরা, বসন্তের মতো মহামারীর প্রকোপে খুব ছোটতেই একাধিক ভাইবোনকে হারিয়েছেন।

মা আদর করে চিন্নাস্বামী(ছোটো রাজা বা little lord) বলে ডাকতেন। ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তিনি বিশেষ আকর্ষণ বোধ করতেন। রামানুজনের জীবনে মায়ের বিশেষ প্রভাব ছিল, মা'র কাছ থেকে ভক্তিগীতি, স্তোত্রপাঠ এবং পুরাণের বহু কাহিনী মুখে শুনেই শিখে ফেলেছিলেন।

এখানে বলে রাখা দরকার রামানুজন এর জন্মের বছর খানেক পরেই তামিলনাডুতে জন্ম নেয় ভারতবর্ষের একমাত্র নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটসাই রমন। তার পাঁচ-ছ' বছরের মধ্যে জন্মেছেন রাশিবিজ্ঞানী প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবীশ, বাঙালী পদার্থবিদ সত্যেন্দ্রনাথ বোস ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা।

যাই হোক যেটা বলছিলাম, রামানুজন এর গণিত মানসিকতার সূক্ষ্মতা, বিশ্লেষণ ক্ষমতা, বুদ্ধির তীক্ষ্ণতার পরিচয় পাওয়া যায় খুব অল্প বয়স থেকেই। π(পাই), e এই ধরনের অমূলদ সংখ্যাগুলির মান নির্ভূল ভাবে অনেকটা বলতে পারতেন, স্কুলে তার জন্য তিনি "exponential boy" নামে পরিচিত ছিলেন। π এর আসন্নমান নির্ণয় করার একাধিক স্বতঃসিদ্ধ তিনি দিয়েছেন, যার একটি হল এরকম-

π/2 = (2/1)x(2/3)x(4/3)x(4/5)x(6/5)x(6/7) ... ... ...

শান্ত স্বভাবের হওযার জন্য সহপাঠীরা বোকা বানিয়ে মজা পেত, যদিও রামানুজন এসব ভ্রক্ষেপ করতেন না, কেউ সহপাঠীদের সাথে অনুরূপ ব্যবহার করতে বললে তিনি রাজী হতেন না।

গণিতের প্রতি তীব্র আগ্রহ থাকলেও অন্যান্য বিষয়ে ছিল চুরান্ত অনীহা, একবার পরীক্ষায় পাচনতন্ত্রের উপর প্রশ্ন ছিল, তার উত্তরে তিনি লিখলেন "Sir, this is my undigested product of the digestion chapter". পরে অবশ্য রামানুজন এর জন্য দূঃখ প্রকাশ করেন। অংকে সেন্ট পারসেন্ট মার্কস্ পেলেও অন্যান্য বিষয়ে কম নম্বরের জন্য তিনি পরের বার ও F. A.(graduation equivalent) অনুত্তীর্ন হন। আর এর সাথে সাথেই গতানুগতিক পড়ার সমাপ্তি হয়, এবং জীবন অন্য দিকে মোর নেয়।

F. A. পরীক্ষায় ফেল করায় তিনি কলেজ বৃত্তি হারান। অর্থের প্রয়োজনে শুরু করেন গৃহশিক্ষকতা। সারাদিন নিমগ্ন থাকতেন গণিত চর্চায়, তাই সংসারে ছেলের মন ফেরানোর জন্য মা রামানুজনের বিয়ের বন্দোবস্ত করেন, প্রথমে রাজী না থাকলেও পরে মায়ের জোরাজুরিতে মেনে নেন। ১৯০৯ সালে মায়ের বান্ধবীর মেয়ে ১০ বছরের জানকী আম্মলের সাথে বিয়ে হয়ে যায়। বেকারত্ব, আর্থিক অনটন, সাংসারিক দায়িত্ব এই পরিস্থিতিতে একটা চাকরি খুব জরুরী হয়ে ওঠে রামানুজনের। পরে রামস্বামী আয়ার ও সেশ্যু আয়ারের চেষ্টায় মাদ্রাজ পোর্ট ট্রাস্টে করণিকের পদে চাকরি নেন। এইসময় ইন্ডিয়ান ম্যাথেমেটিক্যাল সোসাইটির জার্নালে রামানুজনের গবেষণালব্ধ একাধিক গাণিতিক সমস্যা প্রকাশিত হয়।

গণিতে তাঁর সহজাত দক্ষতার কথা এখন অনেকটাই সর্বজনবিদিত। এই অবস্থায় রামানুজন তৎকালীন ব্রিটেনের বিশিষ্ট গণিতজ্ঞদের নিজের কাজের মূল্যায়নের জন্য চিঠি লেখেন। Euler-Riemann zeta অপেক্ষকে অভিসারী শ্রেনী(divergent series) নিয়ে চিঠিতে তিনি বেশ কিছু সাংঘাতিকরকম আপাত বিরোধী স্বতঃসিদ্ধ দাবী করে বসেন। যার কয়েকটা এরকম-

1+2+3+4+5+6+ ... ... ... ∞ = -1/12
1^2 +2^2 +3^2 +4^2+ ... ... ... ∞ = 0
1^3 +2^3 +3^3 +4^3+ ... ... ... ∞ = 1/240
(উল্লেখ্য, এখানে '^' চিহ্নটি ঘাত বা Power সূচীত করছে। অর্থাৎ, a^b কে পড়ুন 'a to the power b')

আসলে গাণিতিক পৃথিবীতে অষ্টম আশ্চর্য বলে যদি কিছু থাকে তাহলে তা নিঃসন্দেহে অসীম শ্রেণী বা Infinite Series. সসীমে এই শ্রেণী গুলোর আচরণ গুলোর সাথে অসীমের আচরণের কোনো মিল নেই। যেখানে প্রথম n সংখ্যক স্বাভাবিক সংখ্যার যোগফল বা
1+2+3+4+5+6+ ... .... ... +n = n.(n+1)/2
সেখানে প্রথম স্বতঃসিদ্ধ দাবী করছে অসীম সংখ্যক বাস্তব সংখ্যার যোগফল একটি ঋণাত্মক সংখ্যা - 1/12, এ এক অদ্ভুত, যদিও এর প্রমাণ বোঝার জন্যে কোনো রকেট সায়েন্স জানার দরকার নেই, সেকেন্ডারি এলজেব্রার ধারণাই যথেষ্ট। প্রমাণ নিম্নরূপ-

ধরা যাক, A = 1-1+1-1+1-1+1-1+ ... ... .... ∞
A = 1- (1-1+1-1+1-1+1-1+ ... ... ... ∞)
A = 1- A
2A = 1
অতএব, A = 1/2 ................... (১)

এবং, B = 1-2+3-4+5-6+ ... ... ... ∞
B = 1-2+3-4+5-6+ ... ... ... ∞
_____________________________________
(+) 2B = 1-1+1-1+1-1+1-1+ ... ... ... ∞
2B = A = 1/2 (১ নং থেকে)
B = 1/(2x2) =1/4 ...................... (২)

প্রদত্ত শ্রেণী, S = 1+2+3+4+5+6+ ... ... ... ∞
B = 1-2+3-4+5-6+ ... ... ... ∞
_____________________________________
(-) S-B = 0+4+0+8+0+12+ ... ... ... ∞
= 4(1+2+3+4+5+6+ ... ... ... ∞ )
S-B = 4S
3S = -B
S = -B/3 = -1/(3x4) (২ নং থেকে)

অতএব, 1+2+3+4+5+6+ ... ... ... ∞ = -1/12

প্রত্যাশিত ভাবেই ব্রিটেনের স্বনামধন্য গণিতজ্ঞ G. H. Hardy রামানুজনের এরকম স্বতঃসিদ্ধের প্রমাণ চেয়ে চিঠি লেখেন, এবং দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। রামানুজনের জীবনে হার্ডি'র প্রভাব ছিল অপরিসীম। শুরু হয় রামানুজনের বিদেশ যাত্রা।

বিদেশে প্রথম দিকে ভালো থাকলেও পরে রামানুজনের শরীর খারাপ হয়ে যায়। এর জন্য দায়ী ছিল মূলত তাঁর অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন। কখনও তিনি একটানা ৩০ ঘন্টা গণিত চর্চা করতেন পরবর্তী ২০ ঘন্টা ঘুমোতেন। রামানুজন ছিলেন বিশুদ্ধ নিরামিষাশী, দক্ষিণ ভারতীয় টক-ঝাল খাবার ছিল পছন্দের। বিদেশে নতুন খাদ্যাভাসে অভ্যস্ত হতে যথেষ্ঠ অসুবিধা হচ্ছিল তাঁর। দেশীয় খাদ্যাভাস, পোষাক-পরিচ্ছদের জন্য পাশ্চাত্যের টিটকিরি সহ্য করতে হত, এমনকি বর্ণবিদ্বেষের শিকার হয়েছিলেন। বিদেশে থাকাকালীন তিনি বেশ কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টাও করেন, একবার স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড তাঁকে উদ্ধার করে সসম্মানে ফেরত পাঠায়। সমস্ত প্রতিকূলতা পেরিয়ে ১৯১৬ সালে রামানুজন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন, ১৯১৭ ই রয়্যাল সোসাইটির ফেলো(F.R.S.) নির্বাচিত হন, এরপর ১৯১৮ সালে প্রথম ভারতীয় হিসেবে ট্রিনিটি কলেজের ফেলো নির্বাচিত হন।

অসুস্থ হয়ে যখন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন, তখন হার্ডি একবার রামানুজনের সাথে দেখা করতে আসেন। তিনি যে ক্যাবে করে এসেছিলেন সেটার নম্বর ছিল 1729, রামানুজনকে এই সংখ্যাটা বলতেই তিনি 1729 এর একগাদা মজাদার বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেন, যার কয়েকটা এরকম-

(i) 1729 সেই ক্ষুদ্রতম সংখ্যা যাকে দু'জোড়া ভিন্ন ধনাত্মক সংখ্যার ঘন এর যোগফল আকারে লেখা যায়। অর্থাৎ, 1729 = 12^3 + 1^3 = 10^3 + 9^3
(ii) 1729 এর সমস্ত উৎপাদকের গুনফল 1729 এর চতুর্থঘাতের সমান। এখান থেকে বলা যায় সংখ্যাটির উৎপাদক সংখ্যা 8. যেমন, 1x7x13x19x91x133x247x1729 = 1729^4
(iii) 1729 হল একটা হর্ষদ সংখ্যা, কোনো স্বাভাবিক সংখ্যা যে অঙ্কগুলি দিয়ে গঠিত, তাদের সমষ্টি যদি সেই সংখ্যার একটা উৎপাদক হয়, তাকে হর্ষদ সংখ্যা বলে। লক্ষনীয়, 1+7+2+9=19 যা 1729 এর একটি উৎপাদক।
(iv) 1729 হল তৃতীয় কারমাইকেল সংখ্যা।
(v) 1+7+2+9 =19 এবং 19x91 = 1729,
এরকম আরো অনেক কিছু, যেন সংখ্যারেখার প্রত্যেকটা অবস্থান ছিল রামানুজনের বিশেষ বন্ধু। এই 1729 সংখ্যাটি Hardy-Ramanujan Number বা Taxicab Number নামেও পরিচিত।

স্ত্রী জানকী দেবীর প্রতি রামানুজনের ভালোবাসা ছিল প্রগাঢ়। বিদেশে থাকাকালীন তাদের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ছিল চিঠি। নিয়মিত চিঠি আদানপ্রদান হত। সহকর্মীদের কাছে জানকী দেবীকে "My House" বলে পরিচয় দেন।

ব্রিটেনে রামানুজনের শরীর ভীষন খারাপ হয়ে গেলে ১৯১৯ এর এপ্রিলে দেশে ফিরে আসেন। এসময় স্ত্রী-মা'এর সম্পর্কের অসদ্ভাব, কলহ বুঝতে পারেন, যার প্রভাব রামানুজনের মননে ভীষণরকম পড়েছিল। এরপর ক্ষয় রোগে আক্রান্ত হয়, শরীর ক্রমশ্ শীর্ণকায় হতে থাকে। তাঁর এক বন্ধুর ভাষায় রামানুজন তখন শুধু "a bundle of bones." ১৯২০ এর ১২' ই জানুয়ারি রামানুজন শেষবার হার্ডিকে চিঠি লেখেন, দীর্ঘদিন খোঁজখবর নিতে না পারার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন।

এরপর আসে সেই মূহুর্ত, আজ থেকে ঠিক ১০০ বছর আগে, অর্থাৎ ১৯২০ এর ২৬'শে এপ্রিলের সকালে শেষবারের মত চোখ বুজেন এই ক্ষণজন্মা গণিতজ্ঞ। শিয়রে বসে আছেন স্ত্রী, শয্যার বাবা-মা দুই ভাই এবং কিছু বন্ধু। দিনের শেষে শেষকৃত্য সমাধা হয়। ৩২ বছরের ক্ষুদ্র জীবনে তিনি যা অসামান্য কাজ করে গেছেন তা সারাজীবন অবিনশ্বর হয়ে থাকবে।

রামানুজনের নশ্বর দেহের বিলুপ্ত ঘটলেও তাঁর অবিনশ্বর কাজের মৃত্যু নেই। আজ তাঁর মৃত্যর শতবর্ষ পরেও গণিতে তাঁর মহত্তম কাজ শাখা প্রশাখা মেলে পত্রে-পুষ্পে বিকশিত, তার সৌন্দর্য দীর্ঘকালের নয়, হবে চিরকালের।

তথ্যসূত্র : The Man Who Knew Infinity by Robert Kanigel

* রামানুজনের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনে, ২০১২ সালে দেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিং তাঁর জন্মদিন অর্থাৎ ২২'শে ডিসেম্বরকে "জাতীয় গণিত দিবস" ঘোষনা করেন।

** ২০১৫ সালে রামানুজনের জীবনী অবলম্বনে ব্রিটিশ পরিচালক Matthew Brown, "The Man Who Knew Infinity" শীর্ষক একটি সিনেমা বানান। যেখানে রামানুজনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন আন্তর্জাতিক পুরস্কার বিজয়ী অভিনেতা Dev Patel.