এ যে তোমার তরবারি 
ড. নিতা মিত্র চন্দ 


পৃথিবীর সিংহভাগ মানুষই এখন গৃহবন্দী। কিছু সংখ্যক মানুষ মানবজাতির রক্ষায় লড়াই করছেন এবং সেই কারণে সংক্রামিত হয়ে মৃত্যুবরণও করছেন। এর সাথে বেশ কিছু বয়স্ক ও অসুস্থ মানুষও ভাইরাসে সংক্রামিত হয়ে মৃত্যুর কাছে হেরে গিয়েছেন। এরই মাঝে চলে গেলো গত ২২ শে এপ্রিল ২০২০, পৃথিবীকে সম্মান জানানোর দিন, Earth Day । লক্ষ্যণীয়, বর্তমানের সমস্যা সারা পৃথিবীর সমস্যা এবং দীর্ঘ মেয়াদী সমস্যা । পৃথিবীকে সম্মান জানানোর জন্য প্র্রয়োজন প্রতিদিনই তার পাশে থাকা । যেসব মানুষকে আমরা হারালাম তাঁদের সকলকে শ্রদ্ধা জানিয়ে এবং এই প্রসঙ্গকে সামনে রেখে আমি বিশ্ব পরিবেশ সম্পর্কে দু একটা কথা বলছি – একজন মনস্তাত্ত্বিকের দৃষ্টিকোণ থেকে। 

পরিবেশপ্রেমী ও বিজ্ঞানীরা বহু আগে থেকেই পরিবেশ রক্ষা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে এসেছেন। এজন্য আন্তর্জাতিক সন্মেলনও অনুষ্ঠিত হয়েছে – গৃহীত হয়েছে অনেক সিদ্ধান্তও। কিন্তু প্রয়োগের ক্ষেত্রে গড়িমসি চলছিল। বিশেষজ্ঞদের গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে ,পরিবেশ দূষণের জেরে বছরে যত মানুষ মারা যান বা জীবনমৃত হয়ে থাকেন বা ভবিষ্যত প্রজন্মের যতটা ক্ষতি হবার সম্ভবনা থাকে - তা ভয়ঙ্কর ভাইরাস জনিত ক্ষতি থেকে খুব একটা কম নয়। 

এখানে দাঁড়িয়ে একটা প্রশ্ন মনে জাগে। ভয়ঙ্কর ভাইরাসের জন্য মানুষ যতটা সচেতন হয়েছে , পরিবেশের জন্য কেন ততটা সচেতন হতে পারে নি। এর উত্তর আমরা সমাজমনোবিজ্ঞানীদের কাছ থেকে পেতে পারি। তাদের মতে মানুষ যখন কোনো কাজ করে, তার সঙ্গে একটা মনোভাব (attitude) জড়িয়ে থাকে। এই মনোভাবের শক্তির উপর নির্ভর করে কাজ করার প্রবণতা । আর এই মনোভাবের শক্তি নির্ভর করে তিনটি বিষয়ের উপর – 

১) বিষয়টি ব্যক্তির ব্যক্তিগত স্বার্থ বা ব্যক্তির সুবিধা-অসুবিধার সঙ্গে সম্পর্কিত হলে মনোভাবের শক্তি বেশী হয়। 

২) বিষয়টির ফলাফল পরিষ্কারভাবে বোঝা গেলে মনোভাবের শক্তি বেশী হয়। 

৩)বিষয়টি ব্যক্তির নিজস্ব অভিজ্ঞতার সঙ্গে যুক্ত হলে মনোভাবের শক্তি বেশী হয়। 

এখন দেখা যাক, মনোবিজ্ঞানীদের এই মতবাদ পরিবেশ দূষণের ক্ষেত্র কতটা কার্যকরী ? 

১) পরিবেশ দূষণের হার এতটাই ধীরে যে ব্যক্তির এই সম্পর্কে মনোভাব ততটা প্রবল হতে পারে না। 

২) পরিবেশ দূষণের ফলে যে পরিণতি হচ্ছে বা হতে পারে তা ভয়ঙ্কর ভাইরাস জনিত বিপদের তুলনায় অনেকটাই অস্বচ্ছ বা সম্ভাব্য স্তরে রয়ে গেছে। ফলে পরিবেশ জনিত দূষণ মানুষের কাছে সহজেই বোধগম্য হচ্ছে না। 

৩) পরিবেশ দূষণের প্রভাব ভয়ঙ্কর ভাইরাস জনিত বিপদের তুলনায় অনেকটাই স্থানীয়ভাবে দেখা গেছে। সারা পৃথিবী জুড়ে এত অল্প সময়ের মধ্যে পরিবেশ দূষণের প্রভাব কখনও দেখা যায় নি। সামগ্রিকভাবে পরিবেশ দূষণের প্রভাব তাই সারা পৃথিবীর মানুষের নিজস্ব অভিজ্ঞতায় একইসাথে আসতে পারে নি। 

আমাদের প্রশ্নটির উত্তর পাবার পরে বলতেই পারি যে, ভয়ঙ্কর’ ভাইরাস জনিত পরিবর্তিত পরিস্থিতি আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে শিখিয়ে দিল – কোথাও কোথাও একটু হলেও থামতে হয়। এর আগে কখনই পৃথিবীর সমস্ত দেশ একইসাথে কিছু সময়ের জন্য হলেও ব্যস্ত জীবনকে থামাতে পারে নি। কল্পনাতেও ভাবতে পারে নি, সমস্ত যানবাহন সব একসাথে কিছুদিনের জন্য বন্ধ রাখতে হবে। থামাতে তো বাধ্য হলাম।এর ফলে মানবস্যভতা একবারে ধ্বংস হওয়ার থেকে কিছুটা হয়ত মুক্তি পেলো । তথ্য থেকেই উঠে আসছে - এই অল্পদিনের মধ্যেই পরিবেশ অনেকটাই নির্মল হয়েছে। জ্বালানী নিয়ে আমরা যে চিন্তিত ছিলাম, তার অনেকটাই সঞ্চয় হয়েছে যা মানবজাতিকে সামগ্রিকভাবে অনেকটা বেশী আনন্দ দিয়েছে। 

অনেক মানুষকে হারালাম আমরা – সে বেদনা আড়াল করার কোনও জায়গা নেই। কিন্তু সমাজ মনোবিজ্ঞানীদের মতবাদকে আশ্রয় করে বলতেই পারি – প্রকৃতির কশাঘাত মানুষের অভিজ্ঞতায় স্থায়ী চিহ্ন রাখবে। মানুষ পুরো না হলেও আংশিকভাবে অযথা দৌড়, অযথা প্রতিযোগিতা ,অযথা ভোগের ইচ্ছা সংযত করতে পারবে – মাঝে মাঝে এই আংশিক থামার মাধ্যমে। আর যদি তা না হয়, তবে শেষের সেদিন যে এগিয়ে আসবে তা বলাই বাহুল্য।