প্রশ্নঃ বাংলা আধুনিক গান বলতে কী বোঝ ? এই গানের ধারায় সলিল চৌধুরী অথবা মান্না দে’র অবদান সংক্ষেপে আলোচনা কর ।১+৪ 

উত্তরঃ ‘আধুনিকতার বিচার সময় দিয়ে নয়, মর্জি নিয়ে’- বাংলা আধুনিক গানের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য । প্রায় বিংশ শতকের ৩০ এর দশকে যখন সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনোইতিক পরিবর্তন বাঙালির রুচি, অভ্যাস, মানসিকতা সমস্ত কিছুকেই বদলে দিল – স্বাভাবিক ভাবে তাঁর প্রভাব পড়লো বাংলা গানের জগতেও।আর এই সময়কার সঙ্গীতকেই সাধারণত আধুনিক সঙ্গীত বলে অভিহিত করা হয় ।

সলিল চৌধুরীঃ আধুনিক বাংলা গানের সুর স্রষ্টা এবং গণসংগীতের প্রণেতা হিসাবে একজন স্মরণীয় বাঙালি হলেন সলিল চৌধুরী ।

সলিল চৌধুরী যেমন একাধারে একজন ভারতীয় সঙ্গীত পরিচালক, গীতিকার ও সুরকার তেমনি একজন ভালো কবি ও গল্পকারও বটে । তিনি বাংলা ছাড়াও হিন্দি ও মালয়ালম চলচ্চিত্রেও সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন । 

১৯৪৫ সালে সলিল চৌধুরী তাঁর প্রথম গণসংগীত সৃষ্টি করেন। বিদ্যাধরী নদীর বানভাসি অঞ্চলে কৃষকদের ওপর অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে রচনা করেন, ‘দেশ ভেসেছে বানের জলে ধান গিয়েছে মরে।’ সেই সময়কার কৃষক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সলিল চৌধুরীর আরেকটি গণসংগীত হলো ‘কৃষক সেনাদের মুষ্টি তোলে আকাশে’।

তার পরবর্তী কালের গানগুলোতে তিনি তথাকথিত সমস্ত কিছু নিয়ম ভেঙ্গেছেন – এনেছেন একই গানে তাল পরিবর্তন। সেখানে সুরের চলন, স্থায়ী অন্তরা সঞ্চারীর গতানুগতিকতাকে তুচ্ছ করে এক নতুন রূপনির্মিতির দিকে নিয়ে গেছেন। সলিল অনুরাগী সন্দীপ চট্টপাধ্যায়ের মতে “ সলিল চৌধূরীর হাত ধরেই কাব্যগীতি এসেছে, ব্যালডের ভঙ্গিমাতেও এসেছে, ভোকাল হার্মনি এসেছে, মেজর কর্ডের ব্ব্যাভারের পরিবর্তে সাস্পেন্ডেড কর্ড প্রাধান্য পেয়েছে,সুরের বহু কৌণিকতা দেখা দিয়েছে।“

অথবা 


মান্না দেঃ প্রায় সাত দশকের সঙ্গীতজীবনে মান্না দে বাংলা ছাড়াও বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় প্রায় সাড়ে তিন হাজার গান গেয়েছেন। এর মধ্যে যেমন রয়েছে অসংখ্য সিনেমার গান, তেমনই রয়েছে ধ্রুপদী সঙ্গীত, আধুনিক গান, রবীন্দ্রসঙ্গীত আর নজরুলগীতি।

'তামান্না' ছবিতে সুরাইয়ার সাথে দ্বৈতকণ্ঠে 'জাগো এয় ঊষা' গানটি প্লেব্যাকে তার প্রথম গান । আর ১৯৫৩ সালে 'কতদূরে আর নিয়ে যাবে বলো' গানটি তার রেকর্ড করা প্রথম বাংলা গান । বাংলা আর হিন্দী ছাড়াও অসমীয়া, মারাঠি, মালয়ালম, কন্নড় প্রভৃতি ভাষাতেও প্রচুর গান গেয়েছেন মান্না দে। 

মান্না দের গাওয়া বাংলা গানের তালিকাও সুদীর্ঘ। জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা কয়েকটি বাংলা গানের মধ্যে রয়েছে 'কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই', 'ললিতা, ওকে আজ চলে যেতে বল না', 'আমার ভালবাসার রাজপ্রাসাদে', 'আমি যে জলসাঘরে' প্রভৃতি।

সব ভাষাভাষী মানুষের কাছেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন তিনি। পেয়েছেন দেশ বিদেশের অজস্র পুরস্কার।ভারত সরকার তাঁকে সম্মানিত করেছে চলচ্চিত্র ক্ষেত্রের জন্য সর্বোচ্চ পুরস্কার দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারে। তার আগে পদ্মশ্রী এবং পদ্মভূষণ সম্মাননাও পেয়েছেন মান্না দে।

প্রশ্নঃ বাংলা তথা ভারতের প্রথম প্রাদেশিক ভাষার ব্যান্ড কোন্‌টি ? বাংলা ব্যান্ডের ইতিহাসে এই ব্যান্ডের অবদান সংক্ষেপে আলোচনা করো ।১+৪ 

উত্তরঃ বাংলা তথা ভারতের প্রথম প্রাদেশিক ভাষার ব্যান্ড হচ্ছে ‘মোহিনের ঘোড়াগুলি’ ।

১৯৭৬ সালে কোলকাতায় প্রতিষ্ঠিত একদল ক্ষ্যাপা সঙ্গীতশিল্পী সহকারে নির্মিত ‘মোহিনের ঘোড়াগুলি’ ভারতের প্রথম প্রাদেশিক ভাষার রক ব্যান্ড । 

শ্রেনীকরণঃ রক, ফোক, বাউল, লাতিন প্রভৃতি বিভীন্ন সঙ্গীত ধারার মিশ্রণ থাকায় এই ব্যান্ড কে কোন একটি মাত্র সঙ্গীত শৈলী অনুসারে শ্রেনীকরণ করা অসম্ভব প্রায় ।তবে বাউল এবং বাংলা রক ধারায় লোকসংগীতের ব্যবহার থাকায় একে ফোক-রক ব্যান্ড বলা যেতে পারে । 

ইতিহাসের পথ ধরেঃ কলকাতার বেশ কিছু সঙ্গীত শিল্পী মিলে গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে এই ব্যান্ডটির প্রতিষ্ঠা করেন । প্রাথমিকভাবে তাদের নাম ছিল সপ্তর্ষি । পড়ে তাদের নাম তীরন্দাজ, বি এস সি এবং সবশেষে রঞ্জন ঘোষাল কবি জীবনানন্দ দাশের একটি কবিতার পঙক্তি – ‘মহীনের ঘোড়াগুলি ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে।’ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নাম রাখেন ‘মহিনের ঘোড়াগুলি’ । 

গান চর্চার কথাঃ ১৯৭৭ থেকে ১৯৭৯ পর্যন্ত সময়কালে তিনটি অ্যালবাম প্রকাশ করে এই ব্যান্ড । 

এক) সংবিগ্ন পাখিকূল ও কলকাতা বিষয়ক (১৯৭৭)

দুই) অজানা উড়ন্ত বস্তু বা অ-উ-ব (১৯৭৮)এবং 

তিন) দৃশ্যমান মহীনের ঘোড়াগুলি (১৯৭৯) ।

আশির দশকে ব্যান্ডটি বন্ধ হয়ে গেলেও পরবর্তিতে ১৯৯৫ সালে গৌতম চট্টোপাধ্যায় সমসাময়িক শিল্পীদের নিয়ে ‘আবার কুড়ি বছর পরে’ শিরোনামে মহীনের ঘোড়া গুলির একটি কভার সংকলন প্রকাশ করেন ।


কি ছিলোনা এদের গানে? রাজনীতি থেকে ভিক্ষাবৃত্তি, বিপ্লব থেকে প্রেম – সবকিছুই রয়েছে ‘মহীনের ঘড়াগুলি’র বিভিন্ন গানে । প্রাদেশিক ভাষার প্রথম বাংলা ব্যান্ড হিসাবেই শুধু নয় – পরবর্তী সময়ে তাদেরকে বাংলা রক সঙ্গীতের বা ব্যান্ড সঙ্গীতের পথিকৃৎ বলে বিবেচনা করা হয় । 


প্রশ্নঃ বাংলা লোকসংগীত বলতে কী বোঝ ? লোকগীতির দুইটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে তোমার এলাকায় প্রচলিত যে কোন একটি লোকসংগীত সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও । ১+১+৩

উত্তরঃ বাংলার লোকগীতি এক অনিমেষ রত্নভাণ্ডার। লোকসংগীতের ধারাটিই বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির মূলধারা । গ্রামীণ সৃষ্টিশীল মানুষের জীবন ও মানসজাত সুর-বাণীর যুগল সম্মেলনে যে সংগীত উদ্ভূত হয়ে, প্রাচীনকাল থেকে অদ্যাবধি গ্রামে ও শহরে চর্চিত হয়ে চলেছে তা-ই লোকসংগীত।

লোকসংগীতের বৈশিষ্ট্যঃ ক) লোকসংগীত চিরায়ত । কেবল কানে শুনে শুনেই এ গান লোকের মুখে মুখে প্রচলিত । 

খ) লোকসংগীত স্বতস্ফুর্ত, কোনো কৃত্রিমতা নেই ।

গ) লোকসংগীত গ্রামীণ মানুষের মনের ভাষা, হৃদয়ের আবেদন আর হৃদয়ের আকুলতা ফুটে ওঠে । 

একটি প্রচলিত লোক সঙ্গীতঃ 

ভাওয়াইয়াঃ ভাওয়াইয়া মূলত: ভাবপ্রধান গান। ভাব শব্দ থেকে ভাওয়াইয়া গানের উৎপত্তি। এ গানের মূল সুর নর-নারীর প্রণয়। প্রণয়ের জ্বালাই এতে অধিক রূপায়িত হয়। মৈশাল, গাড়োয়ান, মাহুত প্রমুখ এই প্রণয় গীতির নায়ক।একজন বিখ্যাত ভাওয়াইয়া গায়ক হলেন আববাস উদ্দীন আহমদ। তাঁর জন্ম কোচবিহার জেলার কালজানি নদীর নিকটবর্তী বলরামপুর গ্রামে।

ভাওয়াইয়া গান মূলত কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট অঞ্চলের গান। দোতরা সহযোগে দীর্ঘ লয়ে এ গানগুলো গাওয়া হয়ে থাকে।

ভাওয়াইয়া গান প্রধানত দুই প্রকার- দীর্ঘ সুর বিশিষ্ট ও চটকা সুর বিশিষ্ট। প্রথম শ্রেণীর গানের মধ্যে ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই' ‘যেজন প্রেমের ভাব জানে না' ‘কোন দ্যাশে যান মইশাল বনদূরে' ‘নউতন পিরিতের বড় জ্বালা' ইত্যাদি ।

ভাওয়াইয়া গানের অপর অংশের নাম চট্‌কা গান। ‘ওরে পতিধন বাড়ি ছাড়িয়া না যান' ‘পানিয়া মর মোক মারিলুরে' ওরে কাইনের ম্যায়ার ঠসক বেশি/ব্যাড়ায় শালী টাড়ি টাড়ি' প্রভৃতি গান এ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত।