মহিলা কবিদের মধ্যে অন্যতম | তিনি জন্মগ্রহণ করেন অবিভক্ত বাংলার বাখরগঞ্জ জেলা (পরবর্ত্তিতে বরিশাল জেলার) বাসণ্ডা গ্রামে। তাঁর পিতা চন্ডীচরণ সেন একজন ব্রাহ্মধর্মাবলম্বী, বিচারক ও ঐতিহাসিক লেখক ছিলেন। তিনি ব্রাহ্ম সমাজের বিশিষ্ট নেতা ছিলেন। আজ এই কবির জন্মদিন উপলক্ষে গুগুল বিশেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছে। 

১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই অক্টোবর বরিশাল জেলার (এখন বাংলাদেশে) বাসণ্ডা গ্রামে এক মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বৈদ্য পরিবারে কামিনী সেনের জন্ম। বাবা ছিলেন সেসময়ের বিখ্যাত লেখক ও ব্রাহ্মসমাজের সদস্য চণ্ডীচরণ সেন। পিতামহ নিমচাঁদ সেন ছিলেন ভাবুক ও ধার্মিক প্রকৃতির লোক। কামিনীর শিশু বয়স থেকেই তার পিতামহ তাকে বিভিন্ন শ্লোক আবৃত্তি করে শোনাতেন। তার ভাবধারায় কামিনীর শিশুমন যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছিল। বাড়িতে কোন অতিথি এলে কামিনীকে পিতামহের শেখানো শ্লোক আবৃত্তি করে শোনাতে হত। কালো রঙের প্রতি অনেকেরই একটা স্বাভাবিক বিতৃষ্ণা আছে; কিন্তু কালোর বন্দনা করে এরকমই একটি শ্লোক – 
“না করিব হিংসা না করিব রোষ
সভার মধ্যে পড়িব শ্লোক
ওহে গোরা কালা কেন নিন্দ?
কালা রজনী সভা করে ছন্দ,
কালা অক্ষর জপয়ে পণ্ডিত,
কালা কৃষ্ণ জগতে পূজিত,
কালা কেশে উজ্জ্বল মুখ,
কালা কোকিলের বচন মধুর।” 

কামিনী রায় যে সময়ে মানুষ হয়েছেন তখন মেয়েদের পড়াশোনা শেখার প্রচলন ছিল না। এটি একটি নিন্দনীয় কাজ বলে গণ্য হত। সমাজপতিদের ধারণা ছিল, মেয়েরা লেখাপড়া শিখলেই অন্যের সঙ্গে পত্রালাপ করবে। কামিনীর জননী নিজের চেষ্টায় একটু লেখাপড়া করেছিলেন; তিনি লিখতে ও পড়তে জানতেন। রান্নাঘরে মাটির দেয়ালে শলাকার সাহায্যে অক্ষর লিখতে শুরু করেছিলেন তিনি। লেখা হয়ে গেলে গোবর জল লেপে সেগুলি পরিষ্কার করে রাখতেন যাতে বয়স্কদের চোখে না পড়ে। শোনা যায় কামিনীর জন্মের অব্যবহিত পূর্বে সন্তানের লালন পালন সম্বন্ধে উপদেশ দিয়ে কামিনীর বাবা তার স্ত্রীকে একটি পত্র লিখেছিলেন। যে কোন কারণেই হোক সে পত্র যথাস্থানে না পৌঁছে গ্রামের অন্য এক ব্যক্তির হাতে গিয়ে পড়ে। তিনি চিঠিটি পড়ে কামিনীর পিতামহকে পৌঁছে দেন। এটি জানাজানি হলে এই ‘গর্হিত’ কর্মের জন্য গ্রামে শোরগোল পড়ে যায়।

সিভিলিয়ান কেদারনাথ রায় বিয়ের অনেক আগেই কামিনী রায়ের কবিতার গুণগ্রাহী ছিলেন। তারই আগ্রহে ১৮৯৪ সালে কামিনী সেনকে তিনি পত্নী রূপে গ্রহণ করেন। কামিনী সেন রূপান্তরিত হন কামিনী রায় নামে, যে নামে তিনি পরবর্তী কালে কবি হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। বিয়ের অব্যবহিত পরে কামিনী রায় তেমন ভাবে কবিতা লেখেন নি, শুধু ‘গুঞ্জন’ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছিল। এই সময়ে তিনি গৃহকর্ম ও সন্তান পালনই তার প্রধান কর্তব্য বলে মনে করেছিলেন। জনৈক বন্ধু তাকে কবিতা না লেখার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন –“এগুলিই আমার জীবন্ত কবিতা।”  তিনি সংসারে মন দিয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু তার অদৃষ্টে সুখ বেশি দিন স্থায়ী হয় নি। ১৯০০ সালে তার এক সন্তানের মৃত্যু হয়। ১৯০৮-এ ঘোড়ার গাড়ি উলটে গিয়ে তার স্বামী পরলোক গমন করেন। কন্যা লীলা ও পুত্র অশোকের মৃত্যু ১৯২০ সালে। এত শোকের আঘাতে কবি মুহ্যমান হয়ে পড়েন। পুত্র অশোকের মৃত্যুর পর রচিত হয় তার কাব্যগ্রন্থ ‘অশোক সঙ্গীত’। শোকের আঘাত কাটিয়ে ওঠার জন্য তিনি আবার কবিতা লেখায় মনোনিবেশ করেন। তার গ্রন্থ প্রকাশনার সময় নিয়ে কিছুটা মতপার্থক্য দেখা যায়। তার রচিত কাব্যগ্রন্থ – ‘আলো ও ছায়া’ (১৮৮৯); ‘নির্ম্মাল্য’ (১৮৯০); ‘পৌরাণিকী’ (১৮৯১-৯২ সালে রচিত, ১৮৯৯-এ প্রথম প্রকাশ); ‘অম্বা’ (নাট্যকাব্য, ১৮৯১-এ রচিত ও ১৯১৫ তে প্রকাশিত); ‘গুঞ্জন’ (শিশু কবিতা পুস্তক, ১৯০৫); ‘ধর্ম্মপুত্র’ (অনুবাদ গল্প, ১৯০৭); ‘শ্রাদ্ধিকী’ (১৯১৩); ‘অশোক স্মৃতি’ (স্মৃতিকথা, ১৯১৩); ‘মাল্য ও নির্ম্মাল্য’ (১৯১৩); ‘অশোক সঙ্গীত’ (১৯১৪); ‘সিতিমা’ (গদ্য নাটিকা, ১৯১৬); ‘ঠাকুরমার চিঠি’ (১৯২৩); ‘দীপ ও ধূপ’ (১৯২৯); ‘জীবন পথে’ (১৯৩০) ও ড: যামিনী রায়ের জীবনী (জীবনী গ্রন্থ)। কবিতা ছাড়া বিভিন্ন ধরণের লেখা তিনি লিখলেও মূলতঃ কবি হিসাবেই তিনি খ্যাতি লাভ করেন। তার কবিতা ‘নব্যভারত’, ‘প্রবাসী’, ‘বিচিত্রা’, ‘বঙ্গলক্ষী’ প্রভৃতি পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হত। তার অনেক লেখা রচনা কালের বহু পরে প্রকাশিত হয়েছে।


নারীবাদী ছিলেন কবি কামিনী রায় তবে উগ্র ছিলেন না। বাঙালী ললনাদের মতোই ছিল তার শান্ত স্বভাব। তবে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সব আন্দোলন সংগ্রামের অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দিতেন তিনি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কবি কামিনী রায়কে তার অসামান্য কবি প্রতিভার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ‘জগত্তারিনী’ স্বর্ণপদক প্রদান করে। তিনি ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের ২৯তম অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। শেষ বয়সে তিনি ঝাড়খ-ের হাজারীবাগে বসবাস করতেন। ১৯৩৩-এর ২৭ সেপ্টেম্বর ৬৯ বছর বয়সে এই বিদুষি বাঙালী কবির মৃত্যু হয়।


তথ্যসূত্রঃ ইন্টারনেট