ভালো থেকো

প্রতিদিনের মতন রঞ্জিত ইউনিভার্সিটির ক্লাস করে পড়াতে যাওয়ার জন্য বাস ধরতে যাচ্ছে। কাকতালীয় ভাবে আজ সে সঠিক সময়ে বাস ধরতে পেরেছে। তবে ক্লান্ত শরীর নিয়ে কাব্যরচনা করা খুব একটা সহজ কাজ নয়। তবুও রঞ্জন অনেক চেষ্টা করে রোজ দু-চারটে লাইন নিজের মোবাইলের নোটবুকে রেখে দেওয়ার। আসলে রঞ্জন খুব অবাক হয় নিজের জীবন নিয়ে, মানুষের জীবন নিয়ে৷ কত মানুষ কত বেড়াজাল পার করে। জীবনের সংগ্রামে নিজেদের সামিল করেও ভালো থাকার চেষ্টা করে। রঞ্জন অনেক ভাবে আর অবাক হয়৷ সে প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে ভালো থাকার। এখনও অব্ধি সে তার জীবনে অনেক কিছু পেয়েছে আবার অনেক কিছু হারিয়েছে৷ তবে সেসব নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই৷ থাকবেই বা কেনো! যা শেষ হয়ে যায়, যা আর পাওয়ার আশা নেই, যা একসময় অফুরন্ত আনন্দ দিয়েছে, তা নিয়ে আফসোস করেই বা লাভ কি৷

পাশের জানলা দিয়ে আসতে থাকা ফুরফুরে হাওয়া ক্রমাগত রঞ্জনের উশকোখুষকো চুলগুলো বানের জলের মতন ভাসিয়ে দিচ্ছিলো। রঞ্জন খেয়াল করেনি তার পাশে তারই এক হারিয়ে যাওয়া সময়ের বান্ধবী বসে রয়েছে। মেয়েটির গলার আওয়াজে রঞ্জনের সম্বিত ফিরলো। সে তার বান্ধবীকে চিনতে পেরেছে৷ কিন্তু, স্বভাবসিদ্ধভাবে কথা বলার নূন্যতম সাহস সে জোগাতে পারছে না। আসলে বিশ্বাস বড়ই অদ্ভুত জিনিস। কাচের চেয়েও নরম। বিশ্বাসের সেতু একবার ভেঙে গেলে তা জোড়া লাগা অতি কষ্টকর। অনেক সাহস জুগিয়ে আমতা আমতা করে রঞ্জন মেয়েটির সাথে কথা বলার চেষ্টা করলো।

- হাই! আমি রঞ্জন। আমরা কিন্তু একই টিউশনির ব্যাচে পড়তাম৷ মনে নেই হয়ত তোমার।

- রঞ্জন? কোন্ ব্যাচে বলতো দেখি। আমার ঠিক মনে নেই।

রঞ্জন বুঝতে পারছে না কিকরে রয়িতা তাকে এত সহজে ভুলে যেতে পারে। সে কিছুটা হলেও ইতস্তত বোধ করা শুরু করলো। পেছন থেকে গানের লাইন ভেসে আসছে, "বাতাসে বহিছে প্রেম, নয়নে লাগিলো নেশা, বসন্ত এসে গেছে"। কাশফুলের বাহার দেখলে সত্যিই মনে হবে, এটা পূজোর মরসুম নয়। প্রেমের মরসুম । যদিও রঞ্জনের নরম হৃদয় এখন পাথরসম। পরিবারের দায়দায়িত্ব কাধে নিতে হয়েছে। এক অদ্ভুত চাপের নিম্নপ্রবাহ সে নিজের মধ্যে বুঝতে পারে।

- এই যে কিছু বললাম তো! (রয়িতা প্রায় ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করলো)

- ইয়ে মানে, ওই যে রহমান স্যারের ব্যাচে আমরা ফিজিক্স পড়তে যেতাম। মনে নেই?

একটু ভেবে নিয়ে রয়িতার উত্তর,
-- আরে ওই রঞ্জন! কেমন আছিস বলরে। কতদিন বাদে দেখা বল্। তা কি করছিস এখন? ইউনিভার্সিটি?

-- হ্যাঁ! ওই আর কি। আগের মাসে কেমিষ্ট্রি ডিপার্টমেন্ট জয়েন করলাম রিসার্চ স্কলার হিসেবে। তুই কি করছিস?

-- আমি? আরে আমিতো গ্র‍্যাজুয়েশনটা কম্পলিট করলাম কোনোরকমে। বাড়ির অবস্থা ঠিক নেইরে। মায়ের শরীর খারাপ। ভাই আবার উচ্চমাধ্যমিক দেবে রে। ম্যানেজ করতেই দিনকাল চলে যাচ্ছে রে। এখন একটা ওষুধের দোকানে রিসেপশনিস্ট হিসেবে কাজ করছি। চলে যাচ্ছে৷

রঞ্জন অনেকটাই অবাক হয়ে গেলো। এই কি সেই রয়িতা যে রঞ্জনকে পড়াশুনোর জন্য একসময় প্রায় সবসময়ই গালাগাল দিতো।

-- শুভম কি এখনো তোর সাথে আছে?
-- না!
-- আচ্ছা।
-- এখানে আছিস কোথায় তাহলে?
-- ১০ নং গেটের কাছে। মোহিতের সাথে থাকছি। একটা ভাড়া বাড়ি নিয়েছি।
-- বাপরে! তা রান্না কে করে দেয়?
-- নিজেরাই করি।
-- পারিস?
-- না পারার কি আছে। শিখে নিতে হয়।
-- বাপরে! ফিলোজফার হলি কবে থেকে রে?
-- এতে ফিলোজফির কি দেখলি? অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম দরকার।
-- থাম তো! কম্যুনিস্টদের ফিলোজফি ছাড় এইবার। লিখিস এখনও?
-- হ্যাঁ! যখন সময় হয়।
-- শোনাবি কিছু? নাকি নাম্বারটা দেবো? পরে শোনাবি?
-- শোনাচ্ছি।

এই বলে রঞ্জন তার মোবাইলের নোটপ্যাড খুললো। পড়তে আরম্ভ করলো,

স্বপ্ন যখন রঙ্গমঞ্চে সামিল,
ইচ্ছেরা চায় খালি মুক্তি।
সময় পেরিয়ে গেলে,
ভুলে যেতে হয় সব যুক্তি।
বাধন আমার শক্তিশালী,
রঙিন কিছু দিন,
পাওয়ার মাঝে হতাশার ছাপ,
জীবনের গল্পে সবাই বেরঙিন।

-- বাহ! বেশ লিখেছিস তো। কিন্তু, তুই আবার জীবন নিয়ে এতটা ভাবছিস কবের থেকে রে? আগেতো এরকম ছিলি না।

-- সময়ের সাথে তাল না মেলাতে পারলে চলবে কিকরে বল্!

-- তুই পাক্কা ফিলোজফার হয়েছিস৷

-- কে বানালো শুনি?

পুজোর সময় আসলে মনের বিষন্নতা ভাব কেমন জানি কাটতে থাকে। এই এত্ত আলো আর আলোর সাথে মিশে থাকা বিভিন্ন মানুষের সমাগম নিতান্তই কোনো মায়াজাল নয়। ব্যস্ততায় কাটতে থাকা সময়ে অবকাশটাই আসল।

রঞ্জন আর উত্তরের অপেক্ষা করলো না। রয়িতাকে সরতে বলে বাসের গেটের সামনে দাড়ালো। পেছনে ফেলে আসলো জমে থাকা অভিমান, তথা নিজের স্বভিমান। জীবনযুদ্ধে জয়ীতো সেই হতে পারে যে কিনা নিজের অতীত ছেড়ে, বর্তমানকে আকড়ে ধরে৷ ভালো থাকার প্রানপন চেষ্টা করে৷ পেছন থেকে আবার এক গান ভেসে আসলো,

"ভালো আছি ভালো থেকো
আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো।
ভালো আছি ভালো থেকো
আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো। "