শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে যাঁর কবিতা রুখে দাঁড়াতে শেখায় তিনি কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য
লেখক-শুভাশিস দাশ
বাংলা সাহিত্যে যিনি কিশোর কবি নামে পরিচিত তিনি আমাদের সবার প্রিয় কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য । যিনি পৃথিবীতে খুবই অল্প সময় বেঁচে ছিলেন ।
শৈশব থেকেই লেখালিখির শুরু । সুকান্ত ভট্টাচার্য ১৯২৬ সালের ১৫ আগস্ট কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর পৈতৃক বাড়ি ছিল অবিভক্ত বাংলার ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জের কোটালী পাড়া গ্রামে । বাবা নিবারণ ভট্টাচার্য আর মা সুনীতি দেবী । মার্কসবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ কবির কবিতা তাই সর্বহারা মানুষের সুখ দুঃখ নিয়ে । সুকান্ত কে গণ মানুষের কবি বলা হয়ে থাকে । যাবতীয় শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে তাঁর লেখনী বারবার সোচ্চার হয়ে উঠেছে । তিনিই উচ্চারণ করতে পারেন ' শোনরে মালিক , শোনরে মজুতদার ! /তোদের প্রাসাদে জমা হলো কত মৃত মানুষের হাড় ---
হিসাব কি দিবি তার ?
এই সব উচ্চারণ বাংলা সাহিত্যে একমাত্র তিনি করে গেছেন । এবং তাঁর জন্যে কবিকে বহু প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে । তবু তিনি ছিলেন তাঁর আদর্শে অচল । কখনো আপোষ করেন নি অন্যায়ের সাথে ।
সুকান্ত চেয়েছিলেন সমাজ ব্যবস্থার এক নতুন রুপ তাই তাঁর কাব্যে আমরা দেখতে পাই বিদ্রোহের প্রকাশ ।
মানুষের কল্যাণের জন্য কবি সুকান্ত সবসময় নিবেদিত থেকেছেন । মানবিক চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে বিদ্রোহের ডাক দিয়েছেন বারবার । কবি বাংলা কাব্য সাহিত্যের প্রচলিত ধারাকে কিন্তু পাল্টে দিয়েছেন তাঁর কাব্য দিয়ে । যে কাব্য মানুষের কথা বলে , শোষণের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে বলে । তাঁর রচনা বলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ছাড়পত্র , পূর্বাভাস , মিঠেকড়া , অভিযান , ঘুম নেই , হরতাল , গীতিগুচ্ছ ।
সুকান্ত র কবিতা সাহসী হতে শেখায় । তিনি কাব্য লালিত্য নিয়ে ভাবিত ছিলেন না তাইতো তিনি অকপটে লিখে ফেলেন
' কবিতা তোমায় দিলেম আজকে ছুটি ,
ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় :
পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি ।
কবি জন্মগ্রহণ করেছিলেন এমন একটি সময়ে যখন উপনিবেশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি পৃথিবীতে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে । মানুষের দাসত্ব আর অপমানের বোঝা তাঁকে যারপরনাই বেদনা হত করেছিল আর তাই তাঁর লেখনী সোচ্চার হয়ে ঘোষণা করে
তার চেয়ে পোষ মানাকে অস্বীকার করো ,
অস্বীকার করো বশ্যতাকে ।
চলো , শুকনো হাড়ের বদলে
সন্ধান করি তাজা রক্তের ,
তৈরি হোক লাল আগুনে ঝলসানো আমাদের খাদ্য ।
শিকলের দাগ ঢেকে দিয়ে গজিয়ে উঠুক
সিংহের কেশর প্রত্যেকের ঘাড়ে । '
আজ সারা বিশ্বের সাথে আমাদের দেশেও এক অস্থির সময় উপনীত । রাত পোহালেই খবরের কাগজের পাতা জুড়ে শিশু ধর্ষণ , নারী ধর্ষণ , বেকার যুবকের হাহাকার , ধর্ম নিয়ে লড়াই ! এ এক অসহনীয় যন্ত্রণা আমাদের প্রতিনিয়ত কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে ! রাজনীতির পঙ্কিল আবর্তে ঘুরপাক খেতে খেতে জীবন আজ দিশেহারা ।
নিরাপত্তা নেই শিশুদের , নিরাপত্তা নেই নারীদের । এই সময় বড় বেশি প্রয়োজন সূকাণ্তের কবিতা পাঠ । আমরা দেখি তাঁর লেখায়
তার ছাড়পত্র কবিতায় তিনি লিখেছেন
' এসেছে নতুন শিশু , তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান ;
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ , মৃত আর ধ্বংসস্তূপ পিঠে ।
চলে যেতে হবে আমাদের ।
চলে যাব -- তবু আজ যতক্ষণ দেহের আছে প্রাণ
প্রাণপণে সরাব এ জঞ্জাল ,
এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি
নব জাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার ।
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য অনুভব করতে পেরেছিলেন আজকের পৃথিবীর এই চিত্র ।
জীবনের পরতে পরতে যে যন্ত্রণা মানুষকে ভারাক্রান্ত করে তোলে সেই যন্ত্রণার কথা তাঁর কাব্যে আমরা পাই । আঠার বছর বয়সের যে প্রতিবাদ, সেই প্রতিবাদের ভাষা কে তাঁর বলিষ্ট লেখনী কি সুন্দরী ভাবে আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছে তা তাঁর আঠার বছর কবিতা টি পড়লেই অনুধাবন করা যায় ।
এ বয়স জেনো ভীরু , কাপুরুষ নয়
পথ চলতে এ বয়স যায় না থেমে ,
এ বয়সে তাই নেই কোন সংশয়
এ দেশের বুকে আঠার আসুক নেমে ।
কবি এমন একটা সময়ে জন্মেছিলেন যখন পৃথিবীর চারদিকে আনহার ক্লান্তি যুদ্ধ মহামারী আর দিকে দিকে চরম অস্থিরতা । তিনি যুব সমাজকে যে বার্তা দিয়ে গেছেন তা সর্ব কালের । অনেকে সুকান্ত কে একটা রাজনীতির তকমা লাগিয়ে তাঁর কাব্য প্রতিভাকে ঢেকে দেবার ঘৃণ্য চক্রান্ত করেছে কিন্তু কালের নিয়মে কবি প্রতিভা আপনা হতেই উত্তীর্ন হয়ে গেছে। তাই তো তাঁর কবিতা আজো সমান প্রাসঙ্গিক । যুগে যুগে শাসক পরিবর্তন হলেও শোষণের যে যাঁতাকল
তার থেকে সাধারণের মুক্তি কোথায় ? তাই তো তিনি বারবার উচ্চারণ করেন
' কী হবে আর কুকুরের মতো বেঁচে থাকায় ?
কতদিন তুষ্ট থাকবে আর
অপরের ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট হাড়ে ?
মাত্র একুশ বছর বেঁচেছিলেন এই কবি ।
খুবই অল্প সময় পেয়েছেন কবিতার জন্য তবু এই সময়ের মধ্যে তিনি যা লিখে গেছেন তা আজো বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ হয়ে রয়েছে । পৃথিবীতে যতদিন শোষণ বঞ্চনা থাকবে সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা ততদিন মানুষকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে শেখাবে ।
0 মন্তব্যসমূহ
Thank you so much for your kindness and support. Your generosity means the world to me. 😊