ভগবান
শঙ্খদীপ মাহাতো


- একশো দশ টাকা কেজি, একশো দশ টাকা কেজি, মাত্র একশো দশ টাকা কেজি।
- এই মাত্র একশো দশ?
- হ্যাঁ বাবু। মাত্র একশো দশ। কয়  কেজি দেবো আপনাকে?
- হাফ কেজিই দে রে। একা মানুষের আর কতটাই লাগবে বল্। আমার সাধের পোষ্য ভোলু আর আমিই তো মাত্র..
- তা ঠিক বলেছেন বাবু। আপনার মতন ভদ্র খদ্দের আমি খুব কমই দেখেছি জানেন! ৩০ বছর ধরে আপনি আমার দোকান থেকে মাংস কিনছেন, আজ অব্ধি কোনো অভিযোগ করলেন না, দাম নিয়ে দরাদরি করলেন না। খদ্দের যে ভগবান তা আপনার সাথে দেখা না হলে জানাই হতো না..
- থামতো। এত্ত তেল দিতে হবেনি আর। সাধারন মানুষ মাত্র, কততাই বা সাধ্য। ওপরওয়ালার কাছে আমরা সবাই নগন্য রে, আমরা সবাই নগন্য। ওনার ইচ্ছের কাছে আমরা শ্যাওলাসম।
- আপনি এত্ত বড়ো অফিসার ছিলেন। আর বলছেন, আপনার কিই বা সাধ্য!
- বড়ো অফিসার হয়ত ছিলুম রে, কিন্তু নিজের লোকেদের আর সময় দিতে পারলাম কই বল্!

শ্যামসুন্দরবাবু টাকাপয়সা মিটিয়ে বাড়ির পথে রওনা দিলেন। সকালের বাতাস বড্ড মিষ্টি। শরীরকে শিহরিত করার জন্য যথেষ্ট। মানুষের ভেতরে যে প্রান রয়েছে, আলগা বাতাসের গতি তা ভালো করে বুঝিয়ে দেয়।

একটু এগিয়ে যেতেই শ্যামসুন্দরবাবু রাস্তার ধারে একটি গাছকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন। প্রকান্ড একটি বটগাছ। মানুষজন সুতো বেঁধে দিয়ে পুজোও করে। বিশ্বাস বিশাল জিনিস, অল্প বিশ্বাস থাকতে হয়। অথচ, এখন মানুষ সবেতেই বেশি বেশি শুরু করেছে। অচেনা শক্তির প্রতি বিশ্বাস হোক কিংবা টিভি খুললে নিউজের নামে যে টুপি পড়ানো হয়, তার প্রতি বিশ্বাস। শ্যামসুন্দরবাবু মাঝেমধ্যে ভাবেন, তিনি যে সব বিশ্বাসের মায়াজালকে সবসময়  অনেক দুরেই ঠেলে রেখে এসেছেন। তা সে সম্পর্কর বন্ধন হোক কিংবা ভালোবাসার স্নিগ্ধ বিশ্বাস।

গাছের নীচে আলতো করে বসলেন। তার শকুনের মতন চোখ দিয়ে মানুষ দেখছেন। বাচ্চা মেয়েটি তার মায়ের হাত ধরে স্কুলে যাচ্ছে। দুটো স্কুলে পড়া মেয়ে হাসতে হাসতে যাচ্ছে, আর তাদের পেছন পেছন দশজনের একটি বয়েজ গ্যং (যারা সব্বাই স্কুল ইউনিফর্ম পরেছিলো) সাইকেল নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। তিনি ভাবছেন নিজের কথা। আরেকটু সময় বোধোহয় তার দেওয়া উচিত ছিলো। নিজেকে এবং তার স্ত্রীকে। অকাল প্রয়ান হতো না তাহলে। কিন্তু, প্রকৃতির নিয়ম।

জন্মিলে মরিতে হবে...
অমর কে কোথা রবে...

এত কিছু ভাবছিলেন, হঠাতই শ্যামসুন্দরবাবু একটি ডাক শুনতে পেলেন। একটি বাচ্চা তার কাছে এসে বলছে, দাদু, কিছু খাইনি সকাল থেকে। মা অনেক সকালে কাজে গেছে। আমাকে কিছু খেতে দেবে? কিছু দিলেই হবে। আমাদের স্কুলে মিড ডে মিলের খাওয়ার পেতাম। কিন্তু, ওই যে কিছুদিন আগে স্কুলের বাইরে বিশাল হইচই হলো। অনেক লোক ছিলো দাদু, অনেক লোক। তারা ভগবানের নাম নিচ্ছিলো জানোতো দাদু। আমরা দোতালা থেকে দেখছিলাম। প্রনাম করছিলাম। কিন্তু, তারপর দুমদাম আওয়াজ শুরু হলো, অনেক আওয়াজ... অনেক। সব্বাই চেচামিচি করা শুরু করলাম। সবকিছু থামার পর আমাদের ম্যাডাম বাইরে নিয়ে আসলো। জানোতো দাদু, কত্ত মানুষ তখন, কত্ত রক্ত, কত্ত পুলিশ। আমরা কান্নাকাটি করছিলাম খুব। সেই থেকে আমাদের স্কুল বন্ধ। খেতে পাইনা তাই রোজ।আচ্ছা দাদু, ওরা তো ভগবানের নাম নিলো, আমরা প্রনাম করলাম। তাহলে? আমাদের স্কুল কবে খুলবে? আমাকে কিছু খেতে দাওনা, আমার ভগবান তুমিই হও। আমি তোমাকেও প্রনাম করবো।

শ্যামসুন্দরবাবু বাচ্চাটির সব কথা মন দিয়ে শুনলেন।তিনি ওর জন্য কিছু খাওয়ার দাওয়ারের ব্যবস্থাও করে দিলেন। এখন তিনি বাড়ি ফিরছেন। আজ আর সকালের খবর দেখা হলো না তার। কিন্তু, কঠিন সত্যি শুনে নিলেন তিনি। তার কানে এখনো বাচ্চাটির বলা শেষ লাইনটি দস্তক দিয়ে যাচ্ছে - "আমার ভগবান তুমিই হও৷ তোমাকেও আমি প্রনাম করবো"।

মানুষ মানুষকে ভগবান কি তাহলে এইভাবেই বানায়! শ্যামসুন্দরবাবু ভাবতে শুরু করলেন। নতুন রেডিওতে গান বেজে উঠলো,

"আঁধার এল ব’লে
তাই তো ঘরে উঠল আলো জ্বলে ।।
ভুলেছিলেম দিনে, রাতে নিলেম চিনে-
জেনেছি কার লীলা আমার বক্ষদোলার দোলে ।।
ঘুমহারা মোর বনে
বিহঙ্গগান জাগল ক্ষণে ক্ষণে ।
যখন সকল শব্দ হয়েছে নিস্তব্ধ
বসন্তবায় মোরে জাগায় পল্লবকল্লোলে।"