কোচবিহার রাস মেলায় টমটম গাড়ি: ঐতিহ্যের এক জীবন্ত প্রতীক যা শৈশবের স্মৃতি ফেরায়
কোচবিহার: উত্তরবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী কোচবিহারের শতাব্দী প্রাচীন রাসমেলা মানেই এক আবেগ, আর সেই আবেগের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একটি বিশেষ খেলনা— টমটম গাড়ি। আধুনিকতার ভিড়েও সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি এই খেলনাটি আজও শিশুদের কাছে এক অপার আনন্দের উৎস এবং প্রবীণদের কাছে হারিয়ে যাওয়া শৈশবের নস্টালজিয়া।
টমটম গাড়ির নামকরণের সার্থকতা এর শব্দের মধ্যেই নিহিত। বাঁশ ও মাটির তৈরি এই খেলনাটিকে দড়ি বেঁধে টানলে এর চাকা থেকে এক বিশেষ ধরনের "টম টম" শব্দ উত্থিত হয়, যা থেকেই এর নামকরণ। তবে এর উৎস কেবল একটি খেলনা নয়, এর পেছনে রয়েছে এক ঐতিহাসিক প্রতীকী তাৎপর্য।
জানা যায়, ব্রিটিশ শাসনকালে ঘোড়ায় টানা যে চারচাকা বিশিষ্ট গাড়িগুলি রাজপথের প্রধান বাহন ছিল, সেগুলিরই প্রতীকী রূপ হিসেবে এই খেলনা গাড়ি তৈরি শুরু হয়। একসময় রাজপথের এই পরিচিত দৃশ্যটিই ধীরে ধীরে লোকশিল্পীদের হাতে রূপ নেয় খেলনার, যা কোচবিহারের রাস মেলার অন্যতম জনপ্রিয় আকর্ষণ হয়ে ওঠে। এটি যেন সেই ফেলে আসা অযান্ত্রিক বাহনের স্মৃতি বহন করে চলে, যা প্রযুক্তির যুগেও শিশুদের মন জয় করে রেখেছে।
টমটম গাড়ির অন্যতম বিশেষত্ব হলো এর নির্মাণশৈলী। এটি সম্পূর্ণভাবে প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি হয়:
- উপাদান: বাঁশের কাঠি বা ফালি, পোড়া মাটির বাটি (যা চাকা হিসেবে ব্যবহৃত হয়) এবং রঙিন কাগজ।
- নকশা: শিল্পী তার হাতে এটিকে আকর্ষণীয় নকশা ও রঙে সাজিয়ে তোলেন, যা সহজেই শিশুদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
- আকর্ষণ: এর সরল গঠন, হাতে টানা যাওয়ার সুবিধা এবং বিশেষ 'টম টম' আওয়াজ শিশুদের মনে এক বিশেষ কৌতূহল ও আনন্দ সৃষ্টি করে।
কোচবিহার রাসমেলায় টমটম গাড়ি বিক্রির এই ঐতিহ্য বংশপরম্পরায় চলে আসছে। মজার বিষয় হলো, এই খেলনার বহু বিক্রেতা ও কারিগর মূলত প্রতিবেশী রাজ্য বিহারের কিষাণগঞ্জ এবং অন্যান্য দূরবর্তী অঞ্চল থেকে প্রতি বছর রাস মেলার সময় কোচবিহারে এসে ভিড় জমান। এই কারিগররা মেলার কয়েক মাস আগে থেকেই তাদের নিজ নিজ স্থানে বসে বাঁশ ও মাটির চাকা দিয়ে টমটম তৈরির কাজ শুরু করে দেন।
অনেকের মতে, তাঁদের পূর্বপুরুষের হাত ধরেই এই খেলনা বিক্রির সূচনা। লাভ-ক্ষতির হিসেব সরিয়ে রেখে শুধুমাত্র ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখা এবং শিশুদের মুখে হাসি ফোটানোর তাগিদেই তাঁরা প্রতি বছর মেলায় আসেন। তাঁদের এই প্রচেষ্টা নিশ্চিত করে যে, আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও কোচবিহারের রাসমেলা থেকে টমটম গাড়ির ঐতিহ্য যেন হারিয়ে না যায়।
বর্তমানে যেখানে নিত্যনতুন প্রযুক্তিনির্ভর খেলনা শিশুদের হাতে শোভা পাচ্ছে, সেখানে মাত্র ২০ থেকে ৩০ টাকার মধ্যে বিক্রি হওয়া এই টমটম গাড়ির চাহিদা আজও অপরিসীম। এটি শুধুমাত্র একটি খেলনা নয়, এটি বাংলার লোকশিল্প ও কারিগরদের দক্ষতার প্রতীক। কোচবিহারের স্থানীয় বাসিন্দারা তো বটেই, দূর-দূরান্ত থেকে আসা বহু মানুষ আজও এই রাসমেলা থেকে টমটম গাড়ি কেনেন, কেউ ছোটদের জন্য, আবার কেউবা নিজের শৈশবের স্মৃতিচারণ করার জন্য। এই খেলনা হাতে নিলেই প্রবীণরা যেন মুহূর্তের মধ্যে ফিরে যান তাঁদের সোনালী অতীতে।
টমটম গাড়ি তাই কেবল কোচবিহার রাস মেলার একটি পণ্য নয়; এটি উত্তর-পূর্ব ভারতের এই বৃহত্তম মেলাটির সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক পরিচয়ের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা ঐতিহ্যের এক জীবন্ত প্রতীক হিসেবে আজও উজ্জ্বল।

0 মন্তব্যসমূহ
Thank you so much for your kindness and support. Your generosity means the world to me. 😊