সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রতীক, রবীন্দ্রনাথের রাখী বন্ধন উৎসব
কলকাতা: রাখী বন্ধন উৎসব মূলত ভাই-বোনের বন্ধনের প্রতীক হিসেবে পরিচিত। তবে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই উৎসবকে এক নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করেন, যা বাংলার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ঐক্যের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায় রচনা করে।
১৯০৫ সালে ব্রিটিশ সরকার বাংলা প্রদেশকে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল 'Divide and Rule' (ভাগ করো ও শাসন করো) নীতির মাধ্যমে হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দুর্বল করা। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সমগ্র বাংলা জুড়ে তীব্র প্রতিবাদ শুরু হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বিভেদকামী নীতির বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে বেছে নেন রাখী বন্ধন উৎসবকে।
রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর (৩০শে আশ্বিন), বঙ্গভঙ্গের দিনটিতে কলকাতা, ঢাকা, সিলেটসহ বাংলার বিভিন্ন স্থানে হাজার হাজার হিন্দু ও মুসলিম নারী-পুরুষ রাস্তায় নেমে আসেন। তারা একে অপরের হাতে রাখী বেঁধে এই বার্তা দেন যে, ধর্মের ভিত্তিতে তাদের বিভক্ত করা সম্ভব নয়। এই রাখী ছিল শুধু একটি সুতো নয়, এটি ছিল বাংলার মানুষের ঐক্য, ভালোবাসা এবং সংহতির প্রতীক। এই উৎসবের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, বাংলার মাটি, জল, আলো, বাতাস—সবকিছুই বাঙালি জাতির অভিন্ন পরিচয়।
এই ঐতিহাসিক দিনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বিখ্যাত গান "বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল" রচনা করেন। এই গানের প্রতিটি ছত্রে তিনি বাংলার প্রাকৃতিক উপাদান এবং মানুষের ঐক্যকে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা হিসেবে উপস্থাপন করেন। গানের শেষ অংশে তিনি বলেন, "বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন, বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন—এক হউক, এক হউক, এক হউক হে ভগবান।" এই গানটি সেই সময়ের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের এক অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে ওঠে।
রবীন্দ্রনাথের এই উদ্যোগটি শুধুমাত্র একটি প্রতীকী প্রতিবাদ ছিল না, বরং এটি ছিল ধর্মীয় বিভেদের বিরুদ্ধে এক দৃঢ় সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ। এর ফলে বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত কার্যকর হলেও বাঙালি জাতির মধ্যে ঐক্যের বন্ধন আরও শক্তিশালী হয়। সময়ের সাথে সাথে রাখী বন্ধন উৎসব হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে বাঙালির সম্প্রীতির এক শক্তিশালী স্মারকে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর এই উৎসবটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, ভালোবাসা ও ঐক্যের বন্ধন যেকোনো বিভেদকে অতিক্রম করতে পারে।
রবীন্দ্রনাথের দূরদর্শিতা এবং সৃজনশীলতার ফলেই রাখী বন্ধন উৎসব আজ শুধু পারিবারিক সম্পর্ক নয়, বরং বৃহত্তর সামাজিক সংহতি এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক হিসেবে আমাদের সংস্কৃতিতে স্থান করে নিয়েছে।
0 মন্তব্যসমূহ
Thank you so much for your kindness and support. Your generosity means the world to me. 😊