দিনহাটার ভতকুরার কাঁটা নদী আজও কাঁটা শতাধিক শিশুর স্বপ্ন পথে
দিনহাটা ১ ব্লকের খাদিজা ভূতকুরা গ্রামের কাঁটা নদী যেন আজও অবরুদ্ধ করে রেখেছে শতাধিক শিশুর স্বপ্নপথ। কাঁটা নদীর উপর মজবুত সেতুর অভাবে পাটকাঠি, বাঁশ ও কাঠের ভাঙাচোরা সাঁকোই ভরসা করে প্রতিদিন পড়তে যায় ছাত্রছাত্রীরা। ঝুঁকিপূর্ণ সেই সাঁকোই হয়ে উঠেছে অনিশ্চয়তার প্রতীক। পড়ে যাওয়া, ভিজে যাওয়া বই খাতা, আর দুর্ঘটনার আশঙ্কা নিয়েই প্রতিদিন কাঁটা নদী পার হতে হয় শিশুদের।
খাদিজা ভূতকুরা গ্রামের এক কিলোমিটার দূরে মাতালহাট গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত গৌড় সুন্দরী উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়তে যায় বহু ছাত্রছাত্রী। কিন্তু মাঝখানে বাধা সেই নদী। সাঁকো ছাড়া পথ নেই। জল বেড়ে গেলে বানানো হয় কাঠের ভেলা, হাঁটু জলে হেঁটে কিংবা সাইকেল কাঁধে নিয়ে পাড়ি দেয় কিশোর-কিশোরীরা। এই ঝুঁকি নিতে না পেরে অনেক পরিবার কন্যা সন্তানদের পড়াশোনা বন্ধ করে দিচ্ছে। সপ্তম কিংবা অষ্টম শ্রেণিতেই বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে সন্তানদের। ফলে স্কুলছুটের হার ক্রমেই বাড়ছে।
স্থানীয়রা জানান, সাঁকো পারাপারে বিশেষত সাইকেল পার করে দেওয়ার জন্য ছাত্র পিছু প্রতিদিন ১০ টাকা করে চাওয়া হয়। যাদের সেই সামর্থ্য নেই, তারা বিদ্যালয়ে যেতে পারে না। অনেক সময় সাঁকো থেকে পড়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে। শিশুদের পক্ষে এই ধরনের প্রতিদিনের ঝুঁকি আর আর্থিক চাপ সামলানো অসম্ভব হয়ে পড়ছে।
এই গ্রাম থেকে সাত কিলোমিটার দূরে রয়েছে গোসানিমারি গার্লস স্কুল। যাদের আর্থিক সামর্থ্য রয়েছে, তারা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সেই স্কুলেই পাঠাচ্ছেন মেয়েদের। কিন্তু অধিকাংশ পরিবারেরই সেই সামর্থ্য নেই। যাঁদের সন্তানরা গৌড় সুন্দরী স্কুলে যেতে বাধ্য, তাঁদের চোখে দিনরাত এক হয়ে যায়।
স্থানীয় বাসিন্দা মিলন বর্মন বলেন, “সাঁকো পারাপার করতে গিয়ে আমার মেয়ে পড়ে যায় নদীতে। তারপর আর সাহস হয়নি। নাম কেটে গোসানিমারি গার্লস স্কুলে ভর্তি করেছি।” তাঁর কথাতেই ফুটে ওঠে গ্রামের সাধারণ মানুষের অসহায়তা।
স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্যের স্বামী নির্মল অধিকারী বলেন, “গ্রামের অধিকাংশ পরিবার দারিদ্রসীমার নিচে। ঝুঁকিপূর্ণ সাঁকো পেরিয়ে উচ্চ বিদ্যালয়ে পাঠাতে চায় না কেউ। অনেকেই সপ্তম-অষ্টম শ্রেণিতেই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন।”
এই পরিস্থিতি সম্পর্কে জেলা পরিষদের সদস্য শ্রাবণী ঝাঁ বলেন, “নির্বাচনী প্রচারে এসে সাঁকো ধরে ছাত্রছাত্রীদের পার হতে দেখে মর্মাহত হয়েছি। স্কুল ব্যাগ মাথায় নিয়ে কীভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাফেরা করছে তারা, তা নিজের চোখে দেখেছি। দ্রুত একটি সেতু নির্মাণের জন্য প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছি। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গেই বিবেচনা করা হচ্ছে।”
ক্ষুদ্র চাষাবাদ কিংবা পরিযায়ী শ্রমিকের জীবনযাপন করা এই এলাকার বাসিন্দারা প্রতিদিনই নদী পারাপারের ভয়ংকর বাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছেন। শুধু পড়াশোনা নয়, দৈনন্দিন জীবনের চাষবাস, চিকিৎসা, বাজার সবকিছুর সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে এই সাঁকো। একটি পাকা সেতুর স্বপ্নই এখন গোটা গ্রামের প্রধান চাহিদা। আর সেই স্বপ্নের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে শত শত শিশু-কিশোরের ভবিষ্যত।
0 تعليقات
Thank you so much for your kindness and support. Your generosity means the world to me. 😊