মহাদেবের প্রিয় শ্রাবণ: কেন এই মাসটি শিবভক্তদের জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ?

শ্রাবণ মাস (Sawan Maas / Shravan Month)  মহাদেব (Mahadev)  শিব (Shiva)  শিবভক্ত (Shiv Bhakt / Devotee of Shiva)  জলাভিষেক (Jalabhishek)  কানওয়ার যাত্রা (Kanwar Yatra)  শ্রাবণী সোমবার (Shravani Somwar / Sawan Somwar)


শ্রাবণ মাস, যা বর্ষাকালের আগমনী বার্তা নিয়ে আসে, শুধুমাত্র প্রকৃতির সবুজায়নের মাস নয়, এটি মহাদেব শিবের ভক্তদের জন্য এক বিশেষ পবিত্র সময়। হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে পঞ্চম এই মাসটি ভক্তি, উপবাস এবং আরাধনার মধ্য দিয়ে কাটান শিবভক্তরা। প্রশ্ন হলো, কেন শ্রাবণ মাস মহাদেবের এত প্রিয় এবং কেনই বা এই মাসটি শিবভক্তদের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ?

পৌরাণিক তাৎপর্য: শিবের নীলকণ্ঠ রূপ ও পার্বতীর তপস্যা

শ্রাবণ মাসকে শিবের মাস হিসেবে চিহ্নিত করার পেছনে বেশ কিছু পৌরাণিক কাহিনি প্রচলিত আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সমুদ্র মন্থনের ঘটনা। কথিত আছে, দেবতা ও অসুরদের দ্বারা সমুদ্র মন্থনকালে যখন হলাহল বিষ উৎপন্ন হয়, যা সমগ্র সৃষ্টিকে ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছিল, তখন দেবাদিদেব মহাদেব সেই বিষ পান করে বিশ্বকে রক্ষা করেন। বিষের তীব্রতায় তাঁর কণ্ঠ নীল হয়ে যায়, আর তাই তিনি নীলকণ্ঠ নামে পরিচিত হন। এই বিষের জ্বালা প্রশমনের জন্য দেবতারা তাঁকে জল নিবেদন করেছিলেন। মনে করা হয়, এই ঘটনাটি শ্রাবণ মাসেই ঘটেছিল। তাই শ্রাবণ মাসে শিবলিঙ্গে জল নিবেদন বা জলাভিষেক অত্যন্ত পুণ্য বলে বিবেচিত হয়।

আরেকটি প্রচলিত বিশ্বাস হলো, দেবী পার্বতী মহাদেবকে পতিরূপে পাওয়ার জন্য শ্রাবণ মাসেই কঠোর তপস্যা করেছিলেন। তাঁর ভক্তি ও তপস্যাতেই প্রসন্ন হয়ে শিব তাঁকে পতিরূপে গ্রহণ করেন। এই কারণে অবিবাহিত মেয়েরা ভালো স্বামী পাওয়ার আশায় শ্রাবণ মাসের সোমবার ব্রত (শ্রাবণী সোমবার) পালন করেন।

পালিত প্রথা ও আধ্যাত্মিক গুরুত্ব

শ্রাবণ মাসে শিবভক্তরা বিভিন্ন ধরনের আরাধনা ও প্রথা পালন করেন, যা এই মাসের গুরুত্বকে আরও বাড়িয়ে তোলে:

  • শ্রাবণী সোমবার ব্রত: এই মাসের প্রতিটি সোমবার শিবের জন্য নিবেদিত। ভক্তরা, বিশেষ করে মহিলারা, এই দিনে উপবাস রাখেন এবং শিবলিঙ্গে জল, দুধ, বেলপাতা, ধুতুরা, আকন্দ ফুল, ভাঙ ইত্যাদি নিবেদন করেন। বিশ্বাস করা হয় যে এই ব্রত পালনে মনস্কামনা পূর্ণ হয় এবং জীবনে সুখ-শান্তি আসে।

  • জলাভিষেক ও রুদ্রাভিষেক: শ্রাবণে শিবলিঙ্গে জল ঢালা বা জলাভিষেক অত্যন্ত ফলদায়ী বলে মনে করা হয়। অনেকে পবিত্র নদী থেকে জল (বিশেষত গঙ্গা জল) সংগ্রহ করে শিবলিঙ্গে অর্পণ করেন। বিশেষ করে কানওয়ার যাত্রা এই মাসের এক অন্যতম আকর্ষণ, যেখানে হাজার হাজার শিবভক্ত পায়ে হেঁটে পবিত্র নদী থেকে জল নিয়ে এসে শিব মন্দিরে অর্পণ করেন।

  • বিশেষ পূজা ও স্তোত্র পাঠ: এই মাসে শিবের বিভিন্ন স্তোত্র, যেমন শিব তাণ্ডব স্তোত্র, মহা মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র, শিব চালিসা পাঠ করা হয়। মন্দিরগুলিতে বিশেষ আরতি ও ভজনের আয়োজন করা হয়, যা এক ভক্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করে।

  • ধর্মীয় মেলা ও উৎসব: শ্রাবণ মাসকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শিব মন্দিরগুলিতে বিশেষ মেলার আয়োজন করা হয়। এই মেলাগুলি ধর্মীয় ভক্তির পাশাপাশি এক সামাজিক মিলনমেলায় পরিণত হয়।

প্রকৃতি ও আধ্যাত্মিকতার মেলবন্ধন

শ্রাবণ মাস বর্ষার ঋতুতে আসে, যখন প্রকৃতি নতুন করে প্রাণ ফিরে পায়। চারপাশের সবুজ আর বৃষ্টির স্নিগ্ধতা এক পবিত্র পরিবেশ তৈরি করে, যা আধ্যাত্মিক সাধনার জন্য অত্যন্ত অনুকূল। প্রকৃতির এই নবজীবনের সঙ্গেই শিবের সৃজনশীল এবং সংহারক রূপের এক গভীর সংযোগ রয়েছে। শিবকে প্রকৃতির দেবতা হিসেবেও পূজা করা হয়।

সব মিলিয়ে, শ্রাবণ মাস শিবভক্তদের জন্য এক আত্মিক জাগরণ এবং ভক্তির মাস। এই সময়ে মহাদেবের আরাধনার মাধ্যমে ভক্তরা তাঁর আশীর্বাদ লাভ করেন এবং নিজেদের জীবনকে শুদ্ধ ও পবিত্র করে তোলার চেষ্টা করেন।