জলপাইগুড়ি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় রোগী মৃত্যুর অভিযোগে উত্তপ্ত পরিস্থিতি
২০১১ সালের পর জলপাইগুড়িতে নির্মিত সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল, যা স্থানীয়দের কাছে '১০ তলা হাসপাতাল' নামে পরিচিত, তা চালু করতে প্রয়োজনীয় পরিকাঠামোর অভাবে জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতালের (পরবর্তীতে জেলা হাসপাতাল) একটি বড় অংশকে সেখানে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। বর্তমানে এই দুই হাসপাতাল ক্যাম্পাস নিয়েই জলপাইগুড়ি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল চালু হয়েছে, যেখানে অসংখ্য নতুন বহুতলও নির্মিত হচ্ছে। তবে, মানুষের দীর্ঘদিনের অভিযোগ, হাসপাতালে সবকিছু মিললেও মেলে না সঠিক চিকিৎসা পরিষেবা। সম্প্রতি ভুল চিকিৎসায় রোগী মৃত্যুর অভিযোগ ঘিরে বুধবার রাত থেকে জলপাইগুড়ি মেডিকেল কলেজের সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল চত্বর উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
অভিযোগ অনুযায়ী, বুধবার রাত ৮টা নাগাদ জলপাইগুড়ি কোতোয়ালি থানার মাসকলাইবাড়ি এলাকার ২২ নম্বর ওয়ার্ডের পবিত্র নগর কলোনির বাসিন্দা ৫২ বছর বয়সী নান্টু দে সরকার পায়ে ব্যথা নিয়ে চিকিৎসা করাতে আসেন। তাঁর ছেলে পঙ্কোজ দে সরকারের অভিযোগ, বাবা হেঁটে হাসপাতালে প্রবেশ করেন। ইমার্জেন্সিতে দেখানোর পর তাঁকে পাঁচতলায় সার্জারি বিভাগে ভর্তির জন্য পাঠানো হয়। সেখানে একটি ইনজেকশন দেওয়ার পর থেকেই নান্টু দে সরকারের শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। তাঁর পা অসাড় হয়ে যায়, জিভ আড়ষ্ট হয়ে আসে এবং গা-হাত-পা শক্ত হয়ে যায়।
রোগীর পরিবারের অভিযোগ, চিকিৎসককে ডাকার প্রায় এক ঘণ্টা পর তিনি এসে পৌঁছন এবং রোগীকে দেখে মন্তব্য করেন, "এই রোগীকে তো মেডিসিন বিভাগে ভর্তি করার কথা। সার্জারিতে নিয়ে আসা হল কেন?" রোগীর বাড়ির লোকজনের দাবি, চিকিৎসক আসার পর নতুন করে অক্সিজেন ও স্যালাইন দেওয়া হয়। কিন্তু ওয়ার্ডে ইসিজি (ECG) করার ব্যবস্থা করতে বেশ কিছুটা সময় লেগে যায়। শেষমেশ ইসিজি করার পর চিকিৎসক জানিয়ে দেন, রোগী মারা গেছেন।
রোগী মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই রোগীর পরিজনরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। তাঁদের মূল দাবি ছিল, যে রোগী পায়ে ব্যথা নিয়ে হেঁটে হাসপাতালে ভর্তি হলেন এবং ওয়ার্ডে গেলেন, তাঁর এত দ্রুত মৃত্যু কীভাবে সম্ভব? এর উত্তর জলপাইগুড়ি মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষকে দিতে হবে।
মেডিকেল কলেজের এমএসভিপি (Medical Superintendent cum Vice Principal) কল্যাণ খাঁ জানান, রোগীর অবস্থা আগে থেকেই খারাপ ছিল এবং ডাক্তারবাবুরা তাঁকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। পরিবারের দাবি মেনে ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে মৃতদেহের ময়নাতদন্ত করা হয়েছে এবং ময়নাতদন্তের সময় ভিডিওগ্রাফির ব্যবস্থাও ছিল। তিনি আরও জানান, হাসপাতালের তরফে কোনো গাফিলতি ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখা হবে এবং তেমন কিছু পাওয়া গেলে অবশ্যই পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
ময়নাতদন্তের পর মৃতদেহ অ্যাম্বুলেন্সে করে মাসকলাইবাড়ি শ্মশানের সামনে আসতেই এলাকার মানুষজন বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। মৃতদেহের অ্যাম্বুলেন্স রাস্তাতেই রেখে জলপাইগুড়ি-শিলিগুড়ি সড়ক আটকে এবিপিসি মাঠের সামনে পথ অবরোধ শুরু হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ বাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছলে পরিবারের সদস্য ও এলাকার মানুষজন পুলিশের সঙ্গেও বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন।
মৃত ব্যক্তির স্ত্রী জানান, তাঁদের সাত সদস্যের পরিবারে তাঁর এক ছেলে ভিন রাজ্যে কাজ করতে গেছে এবং বাকি ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে। তাঁর স্বামী শাটারিং মিস্ত্রির কাজ করে পরিবারের মূল আয়ের সংস্থান করতেন। তিনি অভিযোগ করেন যে, ভুল চিকিৎসায় তাঁর স্বামীর মৃত্যু হয়েছে এবং ঘটনাপ্রবাহে এটি প্রমাণিত। তিনি সরকারের কাছে পরিবারের কোনো সদস্যকে কাজের ব্যবস্থা করে দেওয়ার দাবি জানান, অন্যথায় তাঁদের না খেয়ে মরতে হবে।
পরিবারের সদস্যরা আরও দাবি করেন যে, সরকারি গাফিলতিতে রোগী মৃত্যু কখনো প্রমাণিত হবে না, এর জন্য সঠিক তদন্তের প্রয়োজন। দীর্ঘক্ষণ অবরোধ চলার পর, ৭ দিনের মধ্যে প্রশাসনের তরফে ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস পাওয়ার পর ভুল চিকিৎসায় মৃত নির্মাণ শ্রমিকের পরিবারের সদস্য ও এলাকাবাসীরা অবরোধ তুলে নেন।
সারাদিন পরিবারের পাশে থেকে সঠিক তদন্তের দাবি তোলা শ্রমিক নেতা এবং সদর পশ্চিম এরিয়া কমিটির সম্পাদক শুভাশিস সরকার জানান, ভুল চিকিৎসায় এই নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে, যা ঘটনাপ্রবাহে প্রমাণিত। কিন্তু সরকার বিষয়টাকে ধামাচাপা দিতে চাইছে বলে তাঁর অভিযোগ। তিনি ঘটনার সঠিক তদন্ত, দোষীদের শাস্তি এবং মৃত শ্রমিকের পরিবারের একজনকে সরকারি চাকরির ব্যবস্থার দাবি জানান।
0 মন্তব্যসমূহ
Thank you so much for your kindness and support. Your generosity means the world to me. 😊