বারোকোদালীতে শুরু হল একুশ হাত মাশান পূজা ও উত্তরবঙ্গ লোকসংস্কৃতি মেলা
নিজস্ব সংবাদদাতা, তপন বর্মন:
মানবসভতার ঊষালগ্ন থেকেই নানারকম বিশ্বাস ও সংস্কারের ফলে লৌকিক দেবতার উৎপত্তি ।লোকসমাজে পরম্পরা গত লোকবিশ্বাস থেকে নানা প্রকার দেবদেবীর উৎপত্তি ( লৌকিক) ।। আর এই লৌকিক দেবতাদের মধ্যে অন্যতম হলেন মাশান ঠাকুর। গোটা উত্তরবঙ্গ তথা কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং , আলিপুর ,দিনাজপুর,জেলা সহ নেপালের ঝাপামোরাং জেলা, আসামের ধুবড়ি, গোয়ালপাড়া, বঙ্গাইগাঁও, কোকরাঝাড় ও নলবাড়ি প্রভৃতি জেলায় মাসান ঠাকুরের পূজা ব্যাপক ভাবে প্রচলিত হয়ে আসছে।
এই মাশান ঠাকুরের সংখ্যা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে যেমন মতভেদ রয়েছে, তেমনি মাশান ঠাকুরের জন্ম নিয়েও নানান মত প্রচলিত। আবার মাশান ঠাকুরের নানান রূপভেদও লক্ষ্য করার মত। এ প্রসঙ্গে বারোকোদালী গ্রামের মাশান ঠাকুরের বিশালতা উল্লেখযোগ্য। পূজা কমিটির দাবি বারোকোদালী ইয়ং ক্লাবের এই মাশান ঠাকুর উত্তরবঙ্গের সর্বোচ্চ মাশান ঠাকুর। যার উচ্চতা ২১ হাত।
দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে বারোকোদালী গ্রামে এই বিশাল আকৃতির মাশান বাবা এখানে পূজিত হয়ে আসছেন।
কীভাবে শুরু হল এখানে মাশান পূজা?
এই প্রশ্নের উত্তরে বর্তমানে পূজা কমিটির কোষাধ্যক্ষ নিখিল চন্দ্র প্রধান জানান ছেলে বয়সে একদিকে বেকারত্ব অন্যদিকে লোকসংস্কৃতির প্রতি সুগভীর ভালোবাসা এরই মাঝে কয়েক জন মিলে এই মাশান পূজার উদ্যোগ নেন। ড. জয়ন্ত বর্মন বর্তমানে যিনি তুফানগঞ্জ ভাওয়াইয়া একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা তার উদ্যোগে এই ২১ হাত মাশান ঠাকুরের পূজা শুরু হয়। ভক্তবৃন্দের এতটাই সাড়া ফেলেছিল যে পরবর্তীতে এই পূজা উপলক্ষে এখানে মেলা বসে যায়। এছাড়াও তিনি জানান শৈশবে ডাবরিতে গরু বাঁধতে গিয়ে অনেক সময় লাল নিশান দেখতেন। বাড়িতে জিজ্ঞেস করলে বলত সেখানে মাশান বাবার পূজা হয়। তখনও তারা মাশান বাবার যে রূপ কেমন হয় তা জানতেন না। পরবর্তীতে সেই ভাবনা থেকেই এই মাশান পূজার উদ্যোগ।
এখানকার মাশান ঠাকুরের প্রতিমার উচ্চতা ২১ হাত। মাশান ঠাকুরের দাড়িয়ে রয়েছেন। গদা কাঁধের বদলে মাটি স্পর্শ করে আছে। মাশান ঠাকুরের পায়ের কাছে বিশালাকার শাল মাছের মূর্তি রয়েছে। সেই সাথে বাম পাশে বাউদিয়া মাশান ঠাকুরের মূর্তি এবং ডান পাশে মুড়িয়া মাশান ঠাকুরের ছোটো মূর্তি বিদ্যমান। একসঙ্গে সবাই এখানে পূজিত হয়। মাশান পূজায় অনেকে পাঠা কবুতর মানত করেন। এখানে বলির প্রচলন আছে। পাঠা বা কবুতর বলি দেওয়া হয়। এতদ্দেশীয় তান্ত্রিক পূজারী দিয়ে মাশান বাবার পূজা করা হয়। প্রথা অনুযায়ী প্রসাদ হিসাবে দই চিরা কলা দিয়ে কলার ঢোঙায় পূজা করা হয়। এছাড়াও খিচুড়ির প্রচলন আছে।
ভক্তবৃন্দ তাদের মনস্কামনা পূরণ হলে অনেকে সোনা বা রূপার বেলপাতা সহ নানান অলঙ্কার নিবেদন করে থাকেন।
কোচবিহার জেলার তুফানগঞ্জ মহকুমার বারোকোদালী গ্রামের ইয়ং ক্লাবের পরিচালনায় দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে এই মাশান পূজা ও এর পাশাপাশি উত্তর বঙ্গ সংস্কৃতি মেলা হয়ে আসছে।
গত ২৮ শে জানুয়ারি এই মেলার শুভ উদ্বোধন হয়। এই দিন ফিতা কেটে এবং মাশান বাবার প্রতিমার উন্মোচন করে মেলার উদ্বোধন করেন বঙ্গ রত্ন কবি কমলেশ সরকার মহাশয়। সেই সাথে উপস্হিত ছিলেন বারোকোদালী গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান সুদর্শন রায় সহ অনেকেই। আগামী ৪ ফ্রেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলবে এই মেলা।
এবারে আসা যাক মেলা বিশেষত্ব কী?
উত্তরবঙ্গ হল লোকসংস্কৃতির পীঠস্থান। এখানকার মানুষের সংস্কৃতি আজও বিশ্বে সমাদৃত। তাই মাশান পূজার পাশাপাশি উত্তরবঙ্গ রাজবংশী জনজাতির সংস্কৃতি তুলে ধরাও এই মেলার অন্যতম উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। মেলায় দেখা যায় রাজবংশী মানুষের গৃহস্থালীতে ব্যবহৃত হওয়া বিভিন্ন জিনিসের প্রদশর্নী। সেই রাজবংশী মানুষের বিভিন্ন খাবারের স্টল। যেখানে চ্যাং মাছের পোড়া, বেগুন পোড়া, সিদলের ছ্যাঁকা থেকে শুরু করে আরও নানা ন খাবারের দেখা মেলে।
মেলার দক্ষিণ প্রান্তে বসে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আসর। প্রাণের গান ভাওয়াইয়া সংগীতের সুরে মুখরিত হয় বারোকোদালীর আকাশ বাতাস। সম্পূর্ণ লোক যন্ত্রের ব্যবহারে পরিবেশিত হয় সংগীতানুষ্ঠান। কোনও রকম আধুনিক সংগীত যন্ত্রের ব্যবহার এই অনুষ্ঠানে করা হয় না। এক কথায় পুরোপুরি উত্তরবঙ্গের রাজবংশী মানুষের লোকসংস্কৃতির একটা বিশুদ্ধ ভাবনার প্রতিফলন এই মেলায় লক্ষ্য করার মতো।
মেলাকে কেন্দ্র করে মানুষের উন্মাদনা নজর কাড়ার মতো লক্ষ করা যায়। উত্তরবঙ্গ,আসাম থেকে হাজার হাজার মানুষ এই মেলায় আসেন বলে জানান পূজা কমিটির সদস্যরা।
এ প্রসঙ্গে বঙ্গ রত্ন কবি কমলেশ সরকার জানান- "এবছর মাশান বাবার প্রতিমা উন্মোচক হিসেবে যোগ দিতে পারায় আমি আনন্দিত। মেলা হল একটা মিলন স্থল। এই মিলন মেলায় সকলে সকলেই আসুন, আনন্দ উপভোগ করুন। সেই সাথে এই মেলায় প্রদর্শিত রাজবংশী সমাজের লোক প্রযুক্তির নানা বিষয় ও লোক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সত্যিই এটা একটা মেলার গুরুত্বপূর্ণ দিক। আমি এই মেলার সার্বিক সাফল্য কামনা করি।"
0 মন্তব্যসমূহ
Thank you so much for your kindness and support. Your generosity means the world to me. 😊