আরজি করের মর্মান্তিক ঘটনা- নৃত্যের মাধ্যমে প্রতিবাদ হাওড়ার তরুণীদের

আরজি করের মর্মান্তিক ঘটনা- নৃত্যের মাধ্যমে প্রতিবাদ হাওড়ার তরুণীদের


রিমা ঘোষ, আমতা:-

আরজি করের মর্মান্তিক ঘটনা সভ্য সমাজের প্রতিটি মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করেছে। প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে দেশের নাগরিক সমাজ। পথে নেমেছে অন্য দেশের নাগরিকরাও। অপরাধীর চরম শাস্তির দাবিতে রাতের রাস্তা দখল করেছে মহিলারা। মানব বন্ধন তৈরি করে, মোমবাতি জ্বালিয়ে অথবা আলো নিভিয়ে প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে। রোদ, বৃষ্টি উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমেছে জুনিয়র চিকিৎসকরা। সবার মুখে একটাই স্লোগান - জাস্টিস ফর আরজি কর।

এসব পরিচিত প্রতিবাদের পথ ছেড়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে প্রতিবাদ জানালেন হাওড়ার উদয়নারায়নপুরের বেলগ্রামের তরুণী ঋতুজা ধোলে ও তার সঙ্গী একদল কলেজ ছাত্রী। প্রতিবাদী সঙ্গীতের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নৃত্য তিলোত্তমার মর্মান্তিক পরিণতি সবার সামনে তুলে ধরেছে তারা।

নৃত্যের যে একটা নিজস্ব ভাষা আছে সুরজিতের কথা ও গানের সুরে সেটা প্রমাণ করে দিল কাঙ্কিতা, ঋদ্ধিক, রিয়ন, রিয়াসা, রূপসা, শ্রেয়সী ও ঋতুজারা। গানের প্রতিটি কথা বাস্তব হয়ে ফুটে ওঠে তাদের নৃত্যের ছন্দে।

'বড় হয়ে মেয়ে হবে ডাক্তার, নাম তার দ্যাখা যাবে দেশ জুড়ে খবরে...' সন্তানকে ঘিরে এই আকুল প্রার্থনা প্রতিটি মা-বাবার অবচেতন মনের গভীরে বেড়ে উঠতে থাকে। এই প্রার্থনা শাশ্বত। সঙ্গীতের শব্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ডাক্তারের পোশাকে হাসিমুখে আবির্ভাব ঘটে শিল্পী ঋতুজার। তার মিষ্টি উপস্থিতি দর্শকদের মন জয় করে নেয়। স্বাভাবিক ছন্দে বয়ে চলে ঘটনা। হঠাৎ পটপরিবর্তন।

'জীবনের সুরক্ষা যেখানে, রক্ষা পেলনা ডাক্তার...' - আকস্মিক ঝরে সবকিছুই নিভিয়ে যায়। নরপশুদের হাতে আক্রান্ত হয়ে তিলোত্তমা, নির্ভয়ারা গভীর অন্ধকারে হারিয়ে যায়। নাগরিক সমাজের কাছে রেখে যায় জ্বলন্ত প্রশ্ন, 'আর কত অভয়া, আর কত নির্ভয়া, আর কত রক্ত চাও...'। অথবা 'পাপী করে ধর্ষণ, দেশ করে দর্শন কর্তৃপক্ষ কিছু করেনা'- এবড় লজ্জাজনক আর্তনাদ। তারপর চিৎকার করে বলে ওঠে, 'ধর্মতলার মোড়ে কেন যে টাঙিয়ে রাখা হয়না'- এটাই তো প্রতিটি সৎ প্রতিবাদী মানুষের একান্ত দাবি। এটা পূরণ হলে হয়তো কিছুটা হলেও সমাজের পরিবর্তন হতে পারত।

বলিষ্ঠ প্রতিবাদী সঙ্গীতের প্রতিটি শব্দ সবার কাছে জীবন্ত হয়ে ওঠে ঋতুজা ও তার সঙ্গীদের নৃত্যের মধ্য দিয়ে। শুধু অপরাধী নয় একইসঙ্গে ঘৃণা ও শ্লেষ ছুড়ে দেয় রাষ্ট্র ও কর্তৃপক্ষের দিকে। তারা যেন বলতে চায় - এ-কেমন কর্তৃপক্ষ যে তার নিজের মেয়েকে রক্ষা করতে পারেনা!

সঙ্গীতটির গীতিকার, সুরকার ও গায়ক হলেন সুরজিৎ সরকার। যেভাবে সঙ্গীতের শব্দগুলো তার কলম থেকে ফুটে উঠেছে সেটা সত্যিই প্রশংসনীয়। ভবিষ্যতে 'বিদ্রোহী গীতিকার' হিসাবে চিহ্নিত হয়ে ওঠার সমস্ত সম্ভাবনা তার মধ্যে আছে। গায়কের কণ্ঠ হতে ঝরে পড়া আগুন সঙ্গীত প্রেমীদের মনে ভাবনার খোরাক এনে দেবেই।

প্রসঙ্গত কলকাতার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের 'ক্লিনিকাল সাইকোলজি'-র ছাত্রী ঋতুজা একজন নৃত্য শিল্পী। আরজি করের মর্মান্তিক ঘটনা তার মনে গভীর প্রভাব ফেলে। দূরত্বের জন্য তার পক্ষে স্বশরীরে কলকাতায় উপস্থিত হয়ে প্রতিবাদ মিছিলে সামিল হওয়া সম্ভব হয়নি। তাই সে আশ্রয় নেয় সঙ্গীত ও নৃত্যের। পাশে পেয়ে যায় মায়ের 'আরাধনা নৃত্য একাডেমী'-র ছাত্র-ছাত্রীদের। গত পাঁচ বছর ধরে এদের সে নৃত্য-প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে। তাদের নিয়েই এই অসাধারণ প্রতিবাদী ভিডিওটি তৈরি করে ফেলে, যেটা ইতিমধ্যে প্রতিবাদের জগতে অন্যমাত্রা এনে দিয়েছে।

ঋতুজা ও তার সঙ্গীদের বক্তব্য - 'উই ওয়ান্ট জাস্টিস' এর দাবিটি আমরা সঙ্গীত ও নৃত্যের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি। শুধু একজন নারী হিসাবে নয়, নাগরিক সমাজের অংশ হিসাবে অভয়ার নির্মম পরিণতির সঙ্গে যুক্ত অপরাধীদের কঠোরতম শাস্তি চাই। আমাদের দাবি এই শাস্তি দ্রুততার সঙ্গে কার্যকর করতে হবে।

যার কলম থেকে বারবার প্রতিবাদী কবিতা বের হয় ভিডিওটি দেখে মুগ্ধ হয়ে ওঠে বার্ণপুরের কবি মুনমুন মুখার্জ্জী। কন্যাসমা ঋতুজা ও তার সঙ্গীদের আশীর্বাদ করে তিনি বলেন - প্রতিবাদের নামে অন্যকে আঘাত বা সরকারি সম্পত্তির ক্ষতিসাধন না করেও অপরাধী ও তাদের আশ্রয়দাতাদের হৃদয় কাঁপিয়ে দেওয়া যায় তার প্রমাণ এই ভিডিওটি। ভবিষ্যতে এটাই হয়তো অহিংস প্রতিবাদের পথ দেখাবে প্রতিবাদীদের।