২৭ জুন, ২০২৪ কলকাতার নিজ বাসভবনে পরলোক গমন করলেন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. পুলিন দাশ। তাঁর মৃত্যুতে শোকাহত আত্মীয় পরিজন থেকে বাংলা বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা। অধ্যাপক ড. পুলিন দাশের স্মৃতিতে কলম ধরলেন তাঁরই গুণীছাত্র অধ্যাপক রঞ্জন রায় ।
স্মৃতির সরণি বেয়ে....
' আসামের প্রান্তসীমায় ছোট্ট শহর -- মার্ঘেরিটা। শহরের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে ডিহিং নদী। নদীর উপরে রেলওয়ে ব্রিজ, যার উপরে পাতা ডিব্রু-সদিয়া রেললাইন। লাইনের উপর দিয়েই চলাচলের পথ, -- সংযোজক উভয়তীরের।'
এরকম একটি শান্ত সবুজের মাঝেই জন্মেছিলেন তিনি। তারপরে ব্রহ্মপুত্র পেরিয়ে গঙ্গার তীরে গিয়ে উপনীত হয়েছিলেন। দেখেছিলেন ছেচল্লিশের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, সাতচল্লিশের যন্ত্রণাদায়ক দেশভাগ। গঙ্গাতীরের তিলোত্তমাকে ছেড়ে, দেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী কলকাতাকে ছেড়ে একদিন পাড়ি দিয়েছিলেন জল-জঙ্গলঘেরা উত্তরবঙ্গে।...
' নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে ট্রেন বদল করে ছোট ট্রেনে চেপে শিলিগুড়ি জংশন স্টেশনে এসে যখন নেমেছিলেন তখন সবে ভোর হয়েছে। স্টেশনে ওঠার সিঁড়ির কিনারায় ট্রাঙ্ক বেডিং নামিয়ে রেখে গিয়েছিল কুলি। পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রেরিত গাড়ির প্রতীক্ষায়। উপাচার্য মশাই জানিয়েছিলেন স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকতে।...
কাঠের পুল, চাঁদমণি চা বাগান পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ঢুকে পড়ে চক্কর দিতে লাগল রিক্সা। রিক্সাওয়ালাকে থামতে বলে হঠাৎই এগিয়ে এলেন এক ভদ্রলোক। ইন্টারভিউ বোর্ডে দেখেছিলেন তাঁকে -- তখনকার বাংলা বিভাগের প্রধান ড. হরিপদ চক্রবর্তী। কাছেই তাঁর কোয়ার্টার। কথা না বাড়িয়ে হাত ধরে টেনে নিয়ে তুলেছিলেন তাঁর আবাসে। তারপরে সেখানে খাওয়া-দাওয়া সেরে বাংলা বিভাগের তিনতলায়। এগারোটায় পার্ট টু-র ক্লাস। ক্লাসে নিয়ে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দিলেন ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে।
সেই শুরু। ২রা ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৬ সালে এভাবেই যাত্রা শুরু করেছিলেন শ্রদ্ধেয় মানুষটি। তারপরে দীর্ঘ অধ্যাপনা জীবনে অসংখ্য কৃতি ছাত্রছাত্রী গড়ার কারিগর। শ্রদ্ধেয় ড. পুলিনবিহারী দাশ। সংক্ষেপে ড.পুলিন দাশ।
তাঁকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম। এ আমার মতো সাধারণের জীবনে বিরাট প্রাপ্তি। পরে তাঁরই সুযোগ্য ছাত্র কবি ও অধ্যাপক নিখিলেশ রায়কে পেয়েছি অগ্রজ ও শিক্ষক হিসেবে। এ এক অদ্ভুত প্রাপ্তি আমার। আমার শিক্ষক যিনি, তিনি আবার আমার শিক্ষকেরও শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ আমার জীবনকে যা দিয়েছে সেটুকু সম্বল করেই জীবনপথ চলছি।
শিক্ষাগুরুদের একজন হিসেবে ড. পুলিন দাসকে ঘিরে স্মৃতির ক্যানভাসে রয়েছে অসংখ্য অমলিন স্মৃতি।
পার্ট ওয়ানে আমাদের 'নীলদর্পণ' নাটক পড়াতেন। রাশভারী গুরু-গম্ভীর মানুষটির জ্ঞানের অসীমতায় তখন খেই হারিয়ে ফেলতাম। পরে নিজে অধ্যাপনা করতে এসে তাঁর বইপত্রের সঙ্গে পরিচিত হয়ে তাঁর পান্ডিত্যের গভীরতাকে আঁচ করতে পেরেছি। তাঁর দুইখন্ডে 'বঙ্গ রঙ্গমঞ্চ ও বাংলা নাটক ' বইটি বাংলা নাট্য-সাহিত্যের ইতিহাসে এক অমূল্য সম্পদ। তাঁর আত্মকথার দলিল ' স্মৃতি জাগানিয়া ' এবং ' স্মৃতির খেয়ায় প্রেরণা ও প্রণতি ' ( প্রকাশক ' অন্যকাগজের তরফে নিখিলেশ রায় ) বইদুটি স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থ হিসেবে সুখপাঠ্য।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতির উত্তাল সময়ে (১৯৯৩-৯৮) তিনি তৎকালীন উপাচার্য এবং সরকারের নির্দয় মনোভাবের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়াতে দ্বিধা করেননি। ( বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে আমার ' নস্টালজিয়া ' বইতে )।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে এসে পরে বিভিন্ন সময়ে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে। খোঁজ খবর নিয়েছেন। আশীর্বাদ করেছেন।
গতকাল তিনি অমৃতলোকে চলে গেলেন। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি স্বর্ণযুগের কৃতি শিক্ষকদের একজন কালের অনিবার্য নিয়মে চলে গেলেন।
তিনি অমৃতলোকে ভালো থাকুন। আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম রইল।
0 মন্তব্যসমূহ
Thank you so much for your kindness and support. Your generosity means the world to me. 😊