"অসীম ধন তো আছে তোমার" সুনীতিকুমার

"অসীম ধন তো আছে তোমার" সুনীতিকুমার



কলমে সন্দীপন ধর

'ভাষাচার্য' শব্দটি উচ্চারিত হলে, একটি মুখই চোখের সামনে ভেসে ওঠে... তিনি সুনীতিকুমার। সপ্রশংস স্নেহ ও অনুরাগে রবীন্দ্রনাথের সম্বোধন 'ভাষাচার্য'। আজকের দিনে (২৯ মে ১৯৭৭) কলকাতা শহরে এই মহাপণ্ডিতের জীবনাবসান হয়েছিল।

দারিদ্র জয় করে তিনি বৈদগ্ধ্যের শিখরে উঠেছিলেন, কিন্তু বিনয় ও শ্রদ্ধার সমতল কখনও ছাড়েননি। একদা, সাময়িক সময়ের জন্যে হলেও, হিন্দুর মহিমায় গর্বিত হয়েছিলেন, কিন্তু আর এস এসের 'হিন্দুত্ব'-এ অবনত, অধ:পতিত হননি কোনোদিন। 'ওডিবিএল'-এর মতো মহাগ্ৰন্থ রচনা করে প্রশংসা ও বিদেশের ডিগ্ৰি অর্জন করেছেন, কিন্তু সে বইয়ের ভুল ধরিয়ে দিয়েছেন প্রবোধ সেন, একথা স্বীকারে কুন্ঠিত হননি। দেশ ও বিদেশের বুধমন্ডলী তাঁর জ্ঞানে কৃতার্থ হয়ে তাঁকে জীবন্ত জ্ঞানকোষ বলেছে, কিন্তু অন্যের জ্ঞানের কাছে ভিক্ষায় হাত পাততে সংকুচিত হননি। এঁকেই বোধহয় বলা যায়, “আমায় তুমি করবে দাতা, আপনি ভিক্ষু হবে--”

ইনিই, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, জ্ঞানার্ণব, বিদ্যাবাচস্পতি....স্বভাবত স্বতন্ত্র, ব্যক্তিত্বে বিশিষ্ট ও বিরল , যাঁর রচনার ভাণ্ডার বিশাল, মেধা ও মনীষা অতুলনীয়, মানব সংস্কৃতির সমগ্ৰ পরিসর যাঁর নখদর্পণে।

নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান, সুনীতিকুমার অবিভক্ত বাংলার হাওড়া জেলার শিবপুরে, জন্মেছিলেন।বাবা হরিদাস চট্টোপাধ্যায় ছিলেন ইংরেজদের সদাগরি অফিসের কেরানি। নিত্য টানাটানির সংসার, মতিলাল শীলের ফ্রি ইস্কুলে ভিড়ের মধ্যে পড়াশোনা করেও প্রবেশিকা পরীক্ষায় সারা বাংলার ছাত্রদের মধ্য ষষ্ঠ স্থান অধিকার করে কুড়ি টাকার জলপানি পেয়েছিলেন, তারপর ওই বৃত্তির টাকায় পেরিয়েছিলেন স্কটিশ, প্রেসিডেন্সি'র গণ্ডি। প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি ও জুবিলি গবেষণা পুরস্কার লাভ এবং শেষে এখানকার পাট চুকিয়ে ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে তিন বছরের জন্য বিলেত। সেখানে প্রখ্যাত পণ্ডিত জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ার্সনকে বিস্মিত করে, বিশ্বখ্যাত ধ্বনিতাত্ত্বিক ড্যানিয়েল জোনসের তত্ত্বাবধানে তাঁর গবেষণার ফসল, ‘দি অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অব দ্য বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ’, সংক্ষেপে ‘ওডিবিএল’ নামে মহাগ্রন্থ। প্রখ্যাত প্রাচ্যবিদ, ‘চর্যাপদ’-এর আবিষ্কারক মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী'র মুগ্ধ মন্তব্য

‘এই ছোকরা নূতন পথ দেখাইয়াছে।’

পড়াশোনায় বিরতিহীন সুনীতিকুমার, এরপরই শুরু করেন, গ্রিক, ল্যাটিন-সহ নানা পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য ভাষার চর্চা, বিশেষ করে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগুলোতে পূর্ণতা অর্জনের আপ্রাণ প্রয়াস। সঙ্গে প্রাকৃত ভাষা, ফার্সি , প্রাচীন আইরিশ, পুরনো ইংরেজি ভাষা সহ গোথিক ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তিনি আলো করেছিলেন ভারতীয় ভাষাতত্ত্বের 'খয়রা' অধ্যাপক হিসেবে।এখানে দীর্ঘ ৩০ বছর কাজ করার পর ১৯৫২ সালে এমেরিটাস অধ্যাপক হিসেবে পুনর্নিযুক্তি।

তাঁর জ্ঞান ও বিদ্যার আশীর্বাদ নিয়ে ভাষাতাত্ত্বিক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় দেশবিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে আলো জ্বেলে বেড়িয়েছেন, আন্তর্জাতিক শিক্ষা সম্মেলনগুলোকে তাঁর ভাষণে সমৃদ্ধ করেছেন, ভারতের জাতীয় অধ্যাপক হয়েছেন। আমার মতো সামান্য শিক্ষার্থীর বিবেচনায়, তাঁর বিদ্যাবত্তা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে বেমানান শুধু একটি কাজই তিনি সারাজীবনে করেছেন, তা পশ্চিমবঙ্গের বিধান পরিষদের অধ্যক্ষতা, যা কংগ্ৰেস দলের রাজনৈতিক বশ্যতার সমতুল ছিল।

রবীন্দ্রনাথ সুনীতিকুমারের জীবনে বনস্পতির ছায়ার মতো বিরাজমান। এত স্নেহ অনুরাগ, এমন প্রশ্রয় ও প্রেরণা তিনি আর কোথাও পাননি। মালয়, সুমাত্রা, বালিদ্বীপ, যবদ্বীপ, শ্যামদেশ ভ্রমণের সময় কবি তাঁকে সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন। প্রাচীন ভারতের শিহরণ জাগানো স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের দানে এবং ভারতীয় মহাকাব্যের প্রজ্ঞায় এসব অঞ্চল একদা আলোকিত ছিল। ঘুরে এসে সুনীতিকুমার লিখলেন ‘রবীন্দ্র সংগমে দ্বীপময় ভারত ও শ্যামদেশ’। ইতিহাসের প্রাচীনতা ও রবীন্দ্র প্রতিভার সমন্বয়ে সুন্দর স্মৃতিময়তা গ্ৰন্থের পাতায় পাতায়।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বাংলাভাষা-পরিচয়’ বইটি উৎসর্গ করেছিলেন সুনীতিকুমারকে, সেখানেই তাঁকে দিলেন ‘ভাষাচার্য' উপাধি। শুধু এইটুকু নয়, পণ্ডিত সুনীতিকে অমরত্ব ও স্বীকৃতি দুইই দিলেন তাঁর 'শেষের কবিতা'য়, তাঁর নায়ক অমিত রে, পাহাড়ের গায়ে পাইনের ছায়ায় শুয়ে গল্পের বই পড়ে না, রোমন্থন করে আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ‘বাংলা ভাষার শব্দতত্ত্ব’।

মুক্ত মন, অবাধ জিজ্ঞাসা, অবিরাম অন্বেষণ, অনন্ত অনুশীলন,..... ভ্রমণ, ভাষাতত্ত্ব, গ্ৰন্থ সংসর্গ, বন্ধু বাৎসল্য, ছাত্রপ্রেম, সর্বোপরি অশেষ খাদ্যপ্রিয়তা, এসব নিয়েই জীবন সায়াহ্নের পরিতৃপ্ত প্রহরের দিনগুলো কাটাচ্ছিলেন ভাষাচার্য। বাড়িতে বলে রেখেছিলেন 'বানপ্রস্থ'র বাসনার কথা, যেখানে তাঁর সাধন ব্রত হবে : ‘তিন হাজার বছরের প্রবুদ্ধ ভারতকে নত হয়ে অন্তরে বরণ করা আর বালকের বিস্ময় বিজড়িত ভালোবাসায় রবীন্দ্রনাথকে হৃদয়ে ধারণ করা।’ কিন্তু তার আর দরকার হয়নি, তিনি গার্হস্থেই তাঁর প্রতিভার আলোকময়, অনির্বাণ শিখায় বাংলার বিদ্যাঙ্গন উদ্ভাসিত করে ১৯৭৭ সালের আজকের দিনে নির্বাপিত হয়েছেন।