নিষিদ্ধপল্লী থেকে আমেরিকার বার্ড কলেজ-এক সাহসিনীর কথা 

shweta-katti


শবরী চক্রবর্তী: 

বলা হয়, জন্মানোর সময়েই আমাদের ভাগ্য স্থির হয়ে যায়, তারপর একে নিয়েই বেঁচে থাকা আর মরে যাওযা। কিন্তু নিষিদ্ধপল্লীতে জন্মে সুদূর আমেরিকার বার্ড কলেজে স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে যাওয়া—নিজের ভাগ্যকে বদলে ফেলাটা সহজ কাজ নয়।

কিন্তু শ্বেতা কাট্টি করেছেন। ২২ বছরের এই মেয়েটির জন্ম মহারাষ্ট্রের কামাথিপুরায়। এই কামাথিপুরা জেলাতে এশিয়ায় অন্যতম বৃহত্তম নিষিদ্ধপল্লীর অবস্থান। আরও তিন বোন, মাতাল সৎ বাবা আর যৌনকর্মী মা—এই ছিল শ্বেতার পৃথিবী। দারিদ্র্যই তাঁর মা বন্দনা কাট্টিকে কর্ণাটকের বেলগাম থেকে এই নিষিদ্ধপল্লীতে নিয়ে আসে। শ্বেতার ছোটোবেলা কেটেছে ভীষণই খারাপ পরিবেশে।

shweta-katti



শ্বেতা জানায়- ‘রোজ রাতে শুনতাম ওখানকার মেয়েরা তাদের মাতাল স্বামীদের হাতে মার খাচ্ছে। এইরকম পরিবেশে ছোটোবেলা কাটানো যেকোনও মানুষ, বিশেষ করে ছোটো মেয়েদের পক্ষে সাংঘাতিক। এই পেশায় থাকলে কখনও সম্মান পাওয়া যায় না, এমনকী এই পরিবেশে বড়ো হলেও নয়।’ 

তাঁর যখন ১২ বছর বয়স, তখন থেকে সৎ বাবার যৌন অত্যাচার সহ্য করেছেন শ্বেতা। ‘আমার জামাইবাবুও অত্যাচার করত। ভয়ে কাউকে কিছু বলতে পারিনি, মাকেও নয় কারণ জানতাম আমাকেই দোষ দেওয়া হবে।’ চুপ করে গেলেন শ্বেতা। ছোটোবেলায় নিজের ভবিতব্য নিয়ে মাথাব্যাথা ছিল না, তাই ঘুরে বেড়িয়ে, টিভি দেখে বেড়াতেন। মা বাধা দিতেন, লাভ হত না। দিন বদলে দিল রাধা, শ্বেতার মায়ের মতোই একজন যৌনকর্মী, সে বলেছিল, ‘তোর জীবনও তোর মায়ের মতোই হবে যদি তুই পড়াশোনা না করিস। আমি পড়াশোনাকেই বেছে নিয়েছিলাম।’ হেসে বললেন তিনি।

সেই শুরু। আর এই পর্বে তাঁর সবথেকে বড়ো সহায় তাঁর মা। ‘মা সব সময় আমার পাশে থেকেছে, উৎসাহ দিয়েছে। মায়ের জন্যই আজ আমি এই জায়গায় আসতে পেরেছি।’ জ্বলজ্বল করে ওঠে শ্বেতার চোখ।

শ্বেতা মেধাবী ছাত্রী। ভালো নম্বর পেয়ে স্কুল-কলেজের পরীক্ষায় পাশ করেন। এই সময়ে তাঁর দেখা হয়েছিল রবিন চৌরাসিয়ার সঙ্গে। বলা যায়, শ্বেতাকে পথ দেখিয়েছেন তিনিই। শিকাগোর বাসিন্দা এই রবিন মুম্বাইয়ের নিষিদ্ধপল্লীর মেয়েদের লেখাপড়া করানোর কাজ শুরু করেছিলেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি শুরু করেন তাঁর এনজিও ‘ক্রান্তি’। এখানে কাজ করত শ্বেতার মা-ও। ২০১২-তে ‘ক্রান্তি’-তে যোগ দেন শ্বেতা। ক্রমাগত কাউন্সেলিং করে তাঁর মনকে শক্তিশালী করা হয়, আত্মবিশ্বাস বাড়ানো হয়। প্রমাণ হয় শ্বেতা যথেষ্ট প্রতিশ্রুতিসম্পন্না। এরপর ‘ক্রান্তি’-র সাহায্যে তিনি ৩০,০০০ মার্কিন ডলার স্কলারশিপ পেয়েছেন নিউ ইয়র্কের বার্ড কলেজে পড়াশোনা করার জন্য। এর মধ্যে আছে তার টিউশন ফি এবং থাকার অর্ধেক খরচ। তিনিই প্রথম মুম্বাইয়ের নিষিদ্ধপল্লী থেকে পড়ার জন্য আমেরিকায় যাচ্ছেন। এই সেপ্টেম্বর থেকেই তাঁর সেখানকার পড়া শুরু হবে।

‘ক্রান্তি’-র জন্য তিনি দেশে তো বটেই, বিদেশেরও বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছেন এবং পিছিয়ে পড়া মেয়েদের উন্নয়নের জন্য কাজ করে চলেছেন। সম্প্রতি নিউজ উইক পত্রিকা এই কাজের জন্য তাঁকে ‘২৫-আনডার-২৫ উইমেন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’–এর তালিকায় জায়গা দিয়েছে মালালা ইউসুফজাইয়ের সঙ্গে। একই কারণে কানাডা-তে একদিনের জন্য কনসেল জেনারেল হয়েছেন তিনি ‘ইন্টারন্যাশনাল ডে অফ দি গার্ল চাইল্ড, ২০১৭-’তে। ২০১৮-তে তিনি ইউ এন ইউথ কারেজ অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছেন।

ভবিষ্যতে শ্বেতা সাইকোলজি নিয়ে পড়াশোনা করতে চান যা তাঁকে আত্মবিশ্বাসহীন, মনোবলহীন মেয়েদের উদ্বুদ্ধ করতে সাহায্য করবে। জীবনে তিনি যা হয়েছেন সবটুকু কৃতিত্ব শ্বেতা মাকে দেন। মাকে ভালো রাখাই তাঁর প্রথম কাজ। আর চান মেয়েদের উন্নতি। তিনি মনে করেন, মেয়েদের অনেক ক্ষমতা, কিন্তু তাকে ঠিকমতো কাজে লাগাতে হবে। সাহায্য করার জন্য অনেক হাত আছে, দেখা দরকার সঠিক ঠিকানায় সেই হাতগুলো পৌঁছোচ্ছে কি না। ‘লক্ষ্য স্থির করো, মন শক্ত করো, এগিয়ে যাও। আমি যদি মারাঠি মাধ্যম থেকে এসে আজ আমেরিকায় পড়াশোনা করতে পারি, তাহলে সবাই পারবে।’ শ্বেতা হেসে ঘোষণা করলেন।