'হি পাতালে'র হিল-টপে

অর্ক দত্ত




আমরা যখন কোনো জায়গায় যাবার প্ল্যান করি তখন মূলতঃ দুটো জিনিস সবার আগে খোঁজ করি, সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর থাকার ভালো হোটেল বা রিসর্ট। ট্রেকিং-এ না গেলে আমিও বাকি সবার মত এই একই ফর্মুলা মেনেই চলি।

গত ডিসেম্বরে 'টেমি টি গার্ডেন'-এর মধ্যে দিন দু'য়েক কাটাবার পর আমার পরের দুই দিনের বুকিং ছিলো পেলিং থেকে একটু দূরে 'হি পাতাল' বা 'হি বার্মিওক' গ্রামের একটি নামকরা রিসর্টে।

আপনারা সবাই জানেন যেকোনো ভালো রিসর্টের অনেকগুলো 'ক্রাইটেরিয়া' থাকে। যেমন, লোকেশান, রুমের কন্ডিশন, সার্ভিস, খাবার-দাবার এবং সর্বোপরি 'আম্বিয়েন্স'। সত্যি বলতে, অন্য বিষয়গুলো রিসর্টের তবু বা হাতের নাগালে, কিন্তু আমরা যারা যাচ্ছি তারা ওখানে গিয়ে ঠিক কী 'খেলা' দেখাব, সেটা ওনাদের পক্ষে ধারণা করা বেশ কঠিন। যদিও কিছুটা অনুমান করে আগে থেকে যে যতটা তৈরি থাকতে পারবে সেটা সেই হোটেল বা রিসর্টের 'প্লাস পয়েন্ট' বলেই ধরা হয়ে থাকে।


হি গ্রামের ওই রিসর্টে গিয়ে ওখানে ঘুরতে আসা মানুষজনকে নিয়ে আমার একটু অন্যধরনের কিন্তু বেশ মজার একটা অভিজ্ঞতা হয়েছিল, সেটাই আজকে আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নেবো। রাগ-বিরক্তি-বিষ্ময়-হতাশা-হাসি...সবমিলিয়ে সে এক অদ্ভুত মিশ্র অভিজ্ঞতাও বলতে পারেন!!


কিন্তু সেইসব শোনার আগে 'হি বার্মিওক' গ্রামটা একসাথে ঘুরে দেখে নেই, চলুন...


এটি সিকিমের পশ্চিম দিকে অবস্থিত, ছোট্ট কিন্তু অতুলনীয় সুন্দর। উচ্চতা প্রায় ৭৫০০ ফুট। এখানে যেতে গেলে আপনাকে এন.জে.পি. স্টেশন বা বাগডোগরা থেকে যাত্রা শুরু করে তিস্তা বাজার পেরিয়ে প্রথমে সিকিমে ঢুকে পড়তে হবে। তারপরে সোজা চলে আসুন জোড়থাং, ওখান থেকে সোরেং হয়ে কালুক বাজার। আর যদি আমার মত টেমি থেকে আসেন, তাহলে রাভাংলা ঘুরে এখানে পৌঁছাবেন। কালুকও এই অঞ্চলের অতি জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পট, 'ইকো ট্যুরিজিমে'র জন্য বেশ বিখ্যাত। এখানে এসে এক কাপ চা আর এক প্লেট মোমো খেতে খেতে দেখবেন এতটা রাস্তা আসার সব ক্লান্তি নিমেষে উধাও হয়ে গেছে। একটু এদিক-ওদিক ঘুরে ফিরে আবার গাড়িতে উঠে পড়ুন। 


বাঁদিকে ঘুরে যে রাস্তাটা ডেন্টাম গেছে, ওইটা দিয়ে সোজা এগিয়ে গেলেই কিছুক্ষন পরে আপনি প্রবেশ করবেন মেঘ-কুয়াশায় ঢাকা, ওক-পাইনের ছায়া ঘেরা, 'ঘুমন্ত বুদ্ধে'র আশীর্বাদ-মাখা হি বার্মিওক গ্রামে। প্রধানত লিম্বু উপজাতির মানুষরাই এখানে থাকেন, সহজ, সরল, আতিথেয়তায় ভরপুর। এই স্থান লিম্বুদের আরাধ্য 'মহাত্মা সিরিজঙ্গা'র আশীর্বাদ-ধন্য, এখানে ওনার স্ট্যাচু এবং পবিত্র গুহা রয়েছে। প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসে, পূর্ণিমার দিন ওনার আবির্ভাব উপলক্ষ্যে গ্রামবাসীরা বর্ণময় উৎসব উৎযাপন করে। ভাগ্যক্রমে আমরা ওইদিন ওখানে উপস্থিত ছিলাম, অসাধারণ অভিজ্ঞতা লাভ করেছি।



গ্রামের একেবারে ওপরের দিকে রাস্তার ধারেই ছিলো আমাদের রিসর্ট। পিচ রাস্তা থেকে কয়েক ধাপ ওপরে অনেকটা খোলামেলা জায়গা নিয়ে রিসর্টটি তৈরি, নীচ থেকে ওপরে যেতে গেলে অল্প কয়েকটি সিঁড়ি ভাঙতে হবে, তার দুই দিক আবার মন্ত্র-পতাকা দিয়ে সাজানো। ওপরে উঠেই বামদিকে রিসেপশন আর ডানদিকে সুসজ্জিত ডাইনিং হল। ওটার পাশ দিয়ে একটু এগোলে প্রশস্ত লন। চারিদিকে প্রচুর গাছপালা, ফুলে ফুলে ভরা। সবুজ লনের একদিকে সারি সারি কটেজ, তার ঠিক পিছনে সীমানা পেরোলে পাহাড় আর জঙ্গল। রিসর্টের যেকোনো জায়গায় দাঁড়িয়ে দৃষ্টি প্রসারিত করলেই দেখবেন শ্বেত-শুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা 'ঘুমন্ত বুদ্ধ' রূপে স্বমহিমায় বিরাজমান। সত্যি বলতে কী আমারতো পেলিং-এর থেকেও ভালো ভিউ মনে হলো। ওখানে বসে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত, 'বুদ্ধ'-র রং বদল দেখতে দেখতেই আপনার দিন কেটে যাবে। আর যদি এপ্রিলে যান, তাহলেতো 'সোনায় সোহাগা', থোকা থোকা রডোডেনড্রন রূপের ডালি নিয়ে আপনার অপেক্ষায়!!


রিসর্ট থেকে বেরিয়ে বাম দিকে গেলে অনেকটা জায়গা জুড়ে রয়েছে এলাচ বাগান। এই গ্রামের বহু মানুষের আর্থিক স্বচ্ছলতার অন্যতম প্রধান উৎস। আস্তে করে বাগানের মধ্যে ঢুকে পড়ুন। সরু রাস্তা ধরে সাবধানে এগিয়ে যেতে যেতে, গ্রামের লোকজনের হাসিমুখের সম্ভাষণ পেতে পেতে কখন দেখবেন পৌঁছে গেছেন একটা ছায়া-সুনিবিড় সবুজ লেকের ধারে। ওটার নাম 'ছায়াতাল'। ওর পাশে দু' দণ্ড বসুন, ঠান্ডা হাওয়ার পরশ মেখে নিজের সাথে একটু কথা বলুন। চাইলে প্রিয় মানুষটিকে সঙ্গে নিয়ে লেকের জলে ভেসে বেড়ান। প্রাণ-মন জুড়িয়ে যাবে, নিশ্চিত করে বলতে পারি!! 


আর রিসর্টের ডান দিকে একটু গিয়ে যে রাস্তাটা সোজা ওপরের ঘন জঙ্গলের দিকে চলে গেল, ওইটা দিয়ে আপনি ইচ্ছে করলে 'ভার্সে রডোডেনড্রন স্যাংচুয়ারি' চলে যেতে পারেন। মাত্রই পাঁচ কিলোমিটার মত ট্রেক-রাস্তা। যত ওপরের দিকে যাবেন, ততই দেখবেন নিঝুম, নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ প্রকৃতি তার বর্ণময় রূপ নিয়ে আপনার সামনে প্রতিভাত। একটানা ঝিঁঝির ডাক আর নাম-না-জানা কত শত পাখির কলকাকলি। যেন এক প্রাগৈতিহাসিক যুগে ভুল করে ঢুকে পড়েছেন। অবিস্মরণীয়, রোমাঞ্চকর সে অনুভূতি!!



রিসর্টে দুই ধরনের থাকার ব্যবস্থা, ডিলাক্স রুম আর সুইট রুম। আমি ডিলাক্স রুমেই ছিলাম, সুইট রুম পাইনি। ওটার ভাড়া বেশি হওয়া সত্বেও কেন ওটা প্রথমেই শেষ, সেই গল্পটা পরে বুঝতে পারবেন!


ডিলাক্স রুমগুলি খুব বড় না হলেও, 'চলে যাবে' টাইপের। পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি, টয়লেট বেশ ছোটো কিন্তু পরিষ্কার। দুটি করে ওপরে-নিচে মিলিয়ে মোট বারোটি রুম। আমি আগে থেকে বলে দোতলায় বুক করেছিলাম। ব্যালকনি থেকেই আপনি সব দেখতে পাবেন, মানে যা যা দেখার জন্য ওখানে গিয়েছেন, আর কী! কিন্তু মজার ব্যাপার হল রুমের দেওয়াল এত সুন্দর 'মেটেরিয়াল' দিয়ে তৈরি, আপনার মনে হবে আপনি বাজারে বসে আছেন! পাশের ঘরের সব কথা আপনি না চাইলেও আপনাকে শুনতে হবেই, আর নিজের 'প্রিভেসি' বজায় রাখতে গেলে ফিসফিস করেই কথা বলতে হবে।



আমি এই প্রসঙ্গে আমার অভিজ্ঞতার ডিটেলিং না দিয়ে শুধু একটা দৃশ্য কল্পনা করতে অনুরোধ করব...


দ্বিতীয় দিন, সন্ধেবেলা:

(আমার পাশের ঘরে একজন মহিলা আর তাঁর মায়ের কথোপকথন)

"হ্যালো... হ্যালো... হ্যালো মা, শুনতে পাচ্ছো?? ধ্যাত তেরি...কী জায়গা মাইরি... শা**, কিছুতেই লাইন লাগেনা...!!! হ্যাঁ...মা, এবার পাচ্ছো...?? বলো বলো..."
"....................."
"আর বলোনা, তোমার জামাই কী এক ঘাটের মড়া জায়গায় নিয়ে এসেছে, না আছে টিভি, না আছে গরম জল, না আছে ফোনের লাইন...!!!"
"......................"
"ঠাণ্ডা??? ঠাণ্ডার কথা আর বলোনা...পুরো হাড় 'পজ্যন্ত' কেঁপে যাচ্ছে...আমিতো এসে সেই যে লেপের তলায় ঢুকেছি আর বেরোবনা বলে দিয়েছি... খাবার নিয়ে এলে খাব, নাহলে ওই 'বাপুজি কেক' আছে তাই খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বো..."
"....................."
"আরে আজকে আবার ট্রেন লেট ছিলো...আসতে আসতেই তো প্রায় সন্ধে হয়ে গেল...কালকে এখান থেকে বেরিয়ে 'সাইডসিন' করে দার্জিলিং চলে যাব..."
"......................"
"এখানে দেখার কিছু নেই...ওই একটা গ্রাম-গ্রাম মত জায়গা...তবে বলল সকালে নাকি কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়..."
"......................."
"হ্যাঁ, হ্যাঁ....আমার মনে আছে, ওই ভূন্তুর জন্য আর রূপার জন্য নিতে হবেতো??? ও আমি কিনে নেব..."
"......................."
"কী??? আবার কার জন্য??? ও, ছোটো ননদের...আচ্ছা, দেখব..."
"......................"
"যাকগে....ওই 'ইষ্টিকুটুম'টা আজকে কতদূর হলো...ওইটা একটু বলত...টিভিটা নেই বলে কখন থেকে আঁকুপাঁকু করছি..."
"......................"
"......................"
(এই স্মরণীয় মুহূর্তে মহিলার স্বামীর প্রবেশ)
"এই বুলু...বুলু...আরে শা** দরজাটা খুলবে তো..."
"আরে খোলাইত আছে... কী হয়েছেটা কী??" (ফোন হাতে ধরে)
"তুমি নারকেল তেল এনেছ?? কোথায় ঢুকিয়েছিলে ওটা??"
"সে কী অত মনে আছে নাকি...দেখতে হবে...কেন, এখন কী হবে?? পরে দিচ্ছি...দাঁড়াও...মায়ের সাথে কথা বলছি..."
"তোমার ফোনের নিকুচি করেছে শা**...তুমি ওটা আমার টাকার প্লাস্টিকের মধ্যে ঢুকিয়েছিলে...সব তেল বেরিয়ে ওই টাকায় লেগে গেছে...এখন কী করব???"
.....................(মহিলা নীরব)

"এইজন্য গা....(অশ্লীল গালি) তোমাদের নিয়ে বেরোতে নেই...বো....(অশ্লীল গালি) বস্তিতে থাক নাকি??? শা**... মাথায় কি গোবর পুরে রেখেছ??"
.....................(মহিলা নীরব)
".............................."
".............................."

(আরও কিছু বাছাই গালি শোনার পরে আমি আর বসে থাকতে পারলাম না...বেরিয়ে পাশের ঘরে টোকা দিলাম...ভদ্র(?)লোককে বাইরে বের করে এনে নিচে মাঠের মধ্যে নিয়ে গেলাম...)


নিচে যেতে যেতে শুনলাম...

"হ্যাঁ...হ্যাঁ...মা, শুনতে পাচ্ছি...তুমি ওই দামড়াটার কথা বাদ দাও...সিরিয়ালের বাকিটা বল..."
".........................................."
".........................................."
এই সত্যি-গল্পের অন্তর্নিহিত 'গল্প'টা আপনারা নিজ গুণে বুঝে নেবেন, আশা রইলো!!

পুনশ্চ: আপনি চাইলে বিকেলবেলায় এশিয়ার দ্বিতীয় উচ্চতম 'সিংশোর ব্রিজ' যেতে পারেন, হি গ্রাম থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার। এটি এশিয়ার দ্বিতীয় উচ্চতম, লম্বায় ২৪০ মিটার, উচ্চতায় ১০০ মিটার। চারিদিক ঘন সবুজ দিয়ে ঘেরা, অনেক নিচে পাহাড়ি নদীর কলতান। ঘুরে-বেড়িয়ে সময় কাটাবার জন্য আদর্শ।

প্রয়োজনীয় তথ্য:
১। বর্ষাকাল বাদ দিয়ে সারা বছরের যেকোনো সময়ই আপনি হি বার্মিওক যেতে পারেন। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি ঠান্ডা বেশি থাকে।
২। এই গ্রাম ও সংলগ্ন অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য ভালোভাবে আত্মস্থ করতে হলে কমপক্ষে দুই থেকে তিন দিন থাকতে হবে।
৩। এখান থেকে আপনি কালুক, উত্তরে, রিনচেংপং বা পেলিং ঘুরতে যেতে পারেন।
৪। হি বার্মিওক গ্রামে আপনি কোনো ওষুধ দোকান, লিকার শপ, এ.টি.এম. ইত্যাদি পাবেন না, তার জন্য আপনাকে ডেন্টাম বা কালুক যেতে হবে। 
৫। এই অঞ্চলের বেশিরভাগ হোটেলে সাধারণত ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড দিয়ে পেমেন্ট করা যায় না, তাই যথেষ্ট পরিমাণে ক্যাশ টাকা সঙ্গে রাখুন।



পথ নির্দেশ: 
এন.জে.পি. স্টেশন বা বাগডোগরা-সেবক রোড-কালিঝোরা-তিস্তা বাজার-মেল্লি-নয়া বাজার-জোড়থাং-সোরেং-কালুক-ডেন্টাম-হি বার্মিওক


আনুমানিক দূরত্ব: 
১. এন.জে.পি. স্টেশন থেকে হি বার্মিওক: ১৩০ কিমি
২. বাগডোগরা থেকে হি বার্মিওক: ১৩৬ কিমি
৩. হি বার্মিওক থেকে কালুক: ১২ কিমি
৪. হি বার্মিওক থেকে রিনচেংপং: ১৫ কিমি
৫. হি বার্মিওক থেকে উত্তরে: ২৬ কিমি
৬. হি বার্মিওক থেকে পেলিং: ৩১ কিমি


গাড়ি ভাড়া:
১. এন.জে.পি. স্টেশন থেকে হি বার্মিওক: ৩০০০-৩৫০০
২. বাগডোগরা থেকে হি বার্মিওক: ৩০০০-৩৫০০