একবিংশ শতাব্দীর স্বাধীনতা দিবসের পুন্য প্রভাতের নির্মল আলোকে অবগাহন করে চেতনার বলয়ে ফিরে আসবে আমার ভারতবর্ষ

                                                                                                                       কলমে-রাহুল ভট্টাচার্য

" আজি অমারাত্রির দুর্গ তোরণ যত/ ধূলি তলে হয়ে গেল ভগ্ন।

         রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

১৫ই আগস্ট। অমাবস্যার কালো রাত্রির পর আলোকোজ্জ্বল এক ভোর। দীর্ঘকাল পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকার পর মুক্ত বাতাসে উড়ে যাবার আনন্দ। ' At the stroke of the midnight hour , when world  sleeps, India  will awake to life and freedom."আনন্দই বটে , স্বাধীন দেশের মাটিতে আকাশে বাতাসে সব জায়গাতেই যেন আনন্দের সুর। তবু সেই আনন্দের ফাঁকে উঁকি দেয় বেদনার হাহাকার। যে রক্তঝরা সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে আজকের এই স্বাধীনতা তা এক জীবন্ত অধ্যায়ের মতো আমাদের মানসে প্রতিভাত হয়ে ওঠে আর মনের সেতার এ বাজিয়ে যায় মর্মস্পর্শী সুর। সুভাষচন্দ্রের মতে, 'মানুষের ফুসফুসের জন্য যেমন অক্সিজেন অপরিহার্য, তেমনি অপরিহার্য মানুষের আত্মার স্বাধীনতা।" আজ স্বাধীনতার ৭৩ বছর অতিক্রান্ত। ভারত এক সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এই স্বাধীন ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে আজ সমীক্ষা করে দেখতে হবে ভারতের গণতন্ত্র কতটা মজবুত। আরও পড়ুনঃ  আগামী নভেম্বর ২০২০ পর্যন্ত বিদ্যালয়গুলিতে মিড ডে মিলে খাদ্য সামগ্রী বিতরণের নির্দেশিকা

পলাশীর প্রান্তরেই রোপিত হয় ইংরেজ শাসনের বীজ আর বণিক বেশে ও বিশ্বাসঘাতকতার মধ্যে দিয়ে তাদের সাম্রাজ্যবাদী শাখা প্রশাখা বিস্তার করে সারা ভারতে। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পর উপনিবেশিক শক্তি উচ্ছেদের জন্য গঠিত হয় বহু সংগঠন- জাতীয় কংগ্রেস থেকে মুসলিম লীগ। দেশকে পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্ত করতে এগিয়ে আসে দেশ মাতৃকার বহু সুযোগ্য সন্তান - গান্ধীজি, নেতাজী, মৌলানা আজাদ, জওহরলাল নেহরু প্রমুখ। দেশের জন্য অকাতরে প্রাণ বলিদান দেন ভগত সিং, ক্ষুদিরাম, বিনয় বাদল দীনেশ, প্রফুল্ল চকি, সুখদেব, রাজগুরু, চন্দ্রশেখর আজাদ, সূর্য সেন আরো অনেক স্বাধীনতা সেনানী। এরপর কখনো নরম পন্থী কখনও চরম পন্থী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৪৭ সালের ১৫ ই অগাস্ট ভারত জেগে ওঠে স্বাধীনতার আনন্দে। আর এর প্রায় আড়াই বছর পর ১৯৫০ সালে ২৬শে জানুয়ারি বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র রূপে আত্মপ্রকাশ আমার ভারতের।

                এখন বিষয় হলো এই গণতন্ত্র কী? শব্দগত অর্থে গণতন্ত্র বলতে বোঝায় জনগণের শাসন। আব্রাহাম লিংকনের মতে গণতন্ত্র হলো ' Government of the people, by the people and  for the people,  গনতন্ত্রের ইংরেজি প্রতিরুপ Democracy . Demos শব্দ টির অর্থ জনগণ আর Cratos শব্দের অর্থ শাসন। সুতরাং democracy বা গণতন্ত্র হলো জনমত পরিচালিত শাসন ব্যবস্থা বা Government based of public opinion বলা যেতে পারে। স্বাধীনতার ৭৩ বছর পেরিয়ে আমরা ২০২০ সালে এসে উপনীত হয়েছি। উন্নয়নের পথে হেঁটে ভারত আজ উন্নতির চরম শিখরে। জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন থেকে প্রযুক্তি বিদ্যার অগ্রগমন, প্রতিরক্ষা থেকে কূটনীতি সবকিছুতেই বিশ্বের তাবর তাবর দেশ গুলো কে টেক্কা দিতে প্রস্তুত আমরা।তবে কি জানেন করোনা আবহে মাঝে মাঝে একটা প্রশ্ন উঁকি দিয়ে যায় মনের চোরা কুঠুরিতে ভারত কি সত্যি উন্নয়নের চরম শিখরে উঠতে পেরেছে ? বিপিন চন্দ্র পালের মতে " ভিতরে যে দাস বাইরে সে স্বাধীন হতে পারে না।" শহরের অট্টালিকা আর ব্যস্ত রাস্তাঘাট আমাদের নজর কাড়ে, কিন্তু একটু চোখ ফিরিয়ে দেখুন শুনতে পাবেন অজস্র ঝুপড়ি বাসীর কান্না, মহামারীর আবহে নিজের প্রাণ বাঁচাতে দীর্ঘপথ নাঙ্গা পায়ে হেঁটে চলে, প্লাটফর্মে মৃত মায়ের পাশে দুধের জন্য কাঁদে শিশু, তারা আজও বিলাসী জীবন আর অনলাইন ক্লাসের কথা ভাবে না ভাবে শুধু দুবেলা দু মুঠো ভাতের কথা। দেশের একটা বড় অংশ আজও বেকারত্বের স্বীকার এই অবস্থায় কি আমরা পূর্ণ স্বাধীন ? একথা সত্যি আজ ভারত ইংরেজ শাসন মুক্ত তবে দারিদ্র্য, বৈষম্য আর বেকারত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ। স্বাধীনতার দীর্ঘ ৭৩ বছর পরে সংবিধান যথাসম্ভব উন্নতি করলেও বেশ কিছু বিয়োগান্তক দিক এখনো রয়ে গেছে। এই সব শৃংখল ভেঙে মুক্তির আলোর ছাড়পত্র পেলে তবেই হবে স্বাধীনতার ৭৩ বছর অতিক্রান্তের সার্থকতা। শরৎচন্দ্র বলেছিলেন " স্বাধীনতাই স্বাধীনতার শেষ নয়। ধর্ম, আনন্দ, শান্তি এরা আরো বড়ো। এদের একান্ত বিকাশের জন্যই তো স্বাধীনতা। নইলে এর মূল্য কোথায়? "

                 ভারত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ভারতের মূল শক্তি দেশের জনগণ। জনগণের ভোটে সরকার নির্বাচিত হয়। সেই সরকার জনগণের স্বার্থে কাজ করে। ১৯৫০ সালে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবার পর অনেক বছর কেটে গেছে। আজ তা বেশ মজবুত। সত্যিই কি তাই। একবিংশ শতাব্দীতে দাড়িয়ে ইন্দিরা , রাজীবের নির্মম হত্যা, সংসদে হামলা,অক্ষর ধামএ হামলা, গণতন্ত্রের বুনিয়াদ কে টলিয়ে দেয়, এছাড়া মুম্বাই হামলা, পাঠান কোট হামলা, উড়ি হামলা, ও সম্প্রতি চীনের নির্লজ্জ কার্যকারিতা এই সব পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলীর একটু চুলচেরা বিচার করলে উত্তরটা নেতিবাচক হবে। গণতন্ত্রের একটা বড় ত্রুটি হলো নানা মুনির নানা মত। স্বাভাবিক ভাবে কোনো একটা আলোচনা করতে গেলে মতানৈক্য দেখা দেয়।এছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা সন্ত্রাসবাদ ও ধর্মীয় মৌলবাদ জাতীয় ঐক্যের মূলে কুঠারাঘাত করে গণতন্ত্রের ভিতকে দুর্বল করে দেয়।

           ভারতের স্বাধীনতার ৭৩ বছরের মাহেন্দ্রক্ষনে স্বাধীনতার প্রাসঙ্গিকতা ও গণতন্ত্র নিয়ে অনেক কথাই হলো। শেষে শুধু একটা কথাই বলার ভারত সে স্বাধীন রাষ্ট্র সে বিষয়ে সন্দেহ নেই, তবে পূর্ন স্বাধীনতা প্রাপ্তির জন্য সচেষ্ট হতে হবে জনগণকে। আমাদের মনে রাখতে হবে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র পরস্পরের পরিপূরক একটির অনুপস্থিতিতে অপরটির কোনো মূল্য নেই। গনতন্ত্রে যতই ত্রুটি থাকুক না কেন আদর্শের দিক দিয়ে গণতন্ত্রের স্থান সবার ঊর্ধ্বে। কাশীকান্ত মৈত্রর মতে " গণতন্ত্র কে বাদ দিয়ে সমাজতন্ত্র, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও সুবিচারের গ্যারান্টি দিতে পারে না।" ইতিহাসও সেই সাক্ষ্য বহন করছে। জন স্টুয়ার্ট মিলের মতে " গণতন্ত্রের সফলতার জন্য চাই গণতান্ত্রিক জনগন" প্রতিটি মানুষ কে নিজ মতামত ব্যক্ত করার সুযোগ দিতে হবে। ভেদ থাকবে না কোনো ধর্মীয় বেড়াজালের, সংখ্যাগুরু, সংখ্যালঘু বলে কোনো বিভেদ থাকবে না।  পরিচয় হবে একটাই  আমরা ভারতবাসী। এতে শুধু গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে না ১৫ ই আগস্ট হয়ে উঠবে যথার্থ অর্থে সার্থক। আর বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায় এর মত আমরাও গলা মিলিয়ে এক হয়ে একসাথে বলতে পারবো 

    " হে গণতন্ত্র আমাকে দিয়ে ফলাও তোমার 


    সোনালি ফসল।"

     

            পরিবর্তনের চক্রপথে জগৎ ও জীবন আবর্তিত। এই পরিবর্তনশীলতার মূল কথা " Old order change the giving  place yielding  to new" অর্থাৎ প্রাচীন কে ছেড়ে দিতে হবে নতুনের পথে। একবিংশ শতাব্দী শুরু করেছে তার যাত্রা ,আর এই নতুন যুগে, নতুন ভোরে আমরা ভারতবাসী যাত্রা শুরু করেছি প্রগতির পথে। ৭৪ তম স্বাধীনতা দিবসের মাহেন্দ্রক্ষনে বলতে চাই আমাদের এই নতুন যাত্রা  আলোর উৎসের পথে তবে সেই উৎস পথের দিশারী হতে হলে চাই সমবেত প্রয়াস।আমার বিশ্বাস একবিংশ শতাব্দীর স্বাধীনতা দিবসের পুন্য প্রভাতের নির্মল আলোকে অবগাহন করে চেতনার বলয়ে ফিরে আসবে আমার ভারতবর্ষ। অতীত কোনো ভুলের পুনরাবৃত্তি নয় মানুষের পৃথিবীতে মানুষের জন্য আমরা রচনা করবো ভালোবাসার ভবিষ্যত।আবারো প্রমান করবো " সারে জাহা সে আচ্ছা, হিন্দুস্তান হামারা"  তাই,স্বাধীনতা দিবসের এই পুণ্যলগ্নে সকল ভারতবাসী উদাত্ত কন্ঠে আকাশ বাতাস মুখরিত করে আবারও গেয়ে উঠুক--

    "বলো বলো বলো সবে,

   শত বীনা বেনু রবে,

ভারত আবার জগৎ সভায়

শ্রেষ্ঠ আসন লবে।"