SER-23, বাঁকুড়া,১২এপ্রিল :
বাঙালীর বার মাসে তেরো পার্বণের মধ্যে অন্যতম একটি পার্বণ হল শিবের গাজন ।
পৌরানিক মতে , ‘গাজন’ শব্দের উৎপত্তি সম্পর্কে বলা হয় গর্জন থেকেই গাজনের জন্ম। মহাদেব বা শিবের নামে সন্ন্যাসীদের উচ্চস্বরে জয়ধ্বনি গর্জনের মতো শোনায়। তার থেকেই গাজন। ভিন্ন মতে ‘গা’ অর্থে গ্রাম, ‘জন’ অর্থে জনগণ, অর্থাৎ গ্রামের জনসাধারণের উৎসব। রাঢ় বাংলার অন্যতম প্রধান উৎসব গাজন, আর সেই গাজনকে কেন্দ্র করেই উৎসাহ উদ্দীপনায় মেতে ওঠে বাঁকুড়াবাসীরা। চৈত্র, বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ এই তিন মাসে শুধু বাঁকুড়াতেই প্রায় দেড়শোরও বেশি মেলা অনুষ্ঠিত হয়, তার মধ্যে বেশির ভাগই গাজন উপলক্ষে। বাঁকুড়ার এক্তেশ্বর, ভুলুই , পীড়রাবনী ফুলজামের মতোই একটি গাজন উৎসব হল গঙ্গাজলঘাঁটির কেশিয়াড়া গ্রামের শিবের গাজন।
গ্রাম্য পরিবেশে সবুজ প্রকৃতির অন্তরালে অবস্থিত শতাব্দী প্রাচীন এই শিব মন্দিরটি । শিবের গাজন উপলক্ষে, প্রতি বছর চৈত্র সংক্রান্তিতে মন্দির সন্মুখস্ত মাঠগুলি ভরে উঠে সারিবদ্ধ দোকানদানিতে । তিলধারণের যায়গা থাকেনা, জেলা থেকে জেলার মানুষের ভীড়ে জমে ওঠে মেলা । মেলায় এসে (চিনির তৈরি) কদমা কিনবে না এমন মানুষ মেলা ভার । এছাড়া মাটি-পাথর-চীনেমাটির পাত্র এবং তালপাতা ও বাঁশের তৈরি জিনিসপত্র মানুষকে আকর্ষিত করে । সঙ্গে থাকে বিভিন্ন ধরনের চড়ক এবং অনান্য জিনিষপত্রের বিশাল সম্ভার ।
চৈত্র মাসের পহেলা থেকে সংক্রান্তি পর্যন্ত প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা ঢাক-টাসা সহযোগে চলে ভগবান শিবের সন্ধ্যারতি । শিবের গাজন আরম্ভ হওয়ার তিনদিন আগে থেকে চলে পাটস্নান ও ভক্তাদোলের পর্ব । অর্থাৎ একটি কাঠের পাটাতনে লোহাদণ্ড গ্রথিত দুটি হাতল যুক্ত শিবাকৃতি হল পাট । শিবের সন্ন্যাসী ভক্তদের ভক্তা বলা হয় । ভক্তাদের মধ্যে মূল ভক্তা পাট মাথায় করে পুকুরে নিয়ে যায়, সঙ্গে যায় কাটল ভক্তারাও । পাট স্নান করিয়ে ফেরার পর মূল ভক্তার মাথা নীচে ও পা দণ্ডের উপরে বেঁধে শুরু হয় ভক্তাদোল । এবং এই তিন দিনে লিঙ্গরুপী শিবকে রাজবেশ , রাখালবেশ, এবং কাঙাল বেশে সাজানো হয় । এবং মন্দিরের আটচালায় চলতে থাকে রামায়ণ গান । পূজোর আগের দিন পাট নিয়ে যাওয়া হয় বিভিন্ন গ্রামে এবং শেষে গ্রামে ফিরে বাড়ি বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয় । হোমের দিন উষা থেকেই চলতে থাকে শিবের পূজার্চনা ।আসতে থাকে ভক্তদের ঢল । এদিন নীল পূজার দিন নামেও পরিচিত । এর পরদিন অর্থাৎ চড়ক পুজোর দিন ভোর বেলা শিবের সব ভক্তারা মিলে পূণ্য অর্জনের জন্য আগুন নিয়ে খেলা , লাঠি খেলা এবং ভক্তাগড়াগাড়ি দেয় । এর পরের দিন সকল মানুষের দেওয়া চাল দিয়ে ভোগ রান্না করা হয় । এবং সবার প্রসাদ গ্রহণের মাধ্যমে শেষ হয় গাজন মেলা । শতাব্দী প্রাচীন এই মেলা তিনদিনের হলেও চলে সাত দিন পর্যন্ত ।
মেলায় স্থানীয় থেকে বড়ো ব্যবসায়ী সকলেই পসরা সাজিয়ে বসেন একটু বাড়তি রোজগারের আশায় । কিন্তু সে সব আজ অতীত । তাদের সব আশা নস্যাৎ করে দিল করোনা ভাইরাস । করোনা ভাইরাসের জেরে রাজ্যজুড়ে লকডাউন । বাড়ি থেকে বাইরে যাওয়া নিষেধ । তাই মন্দির কতৃপক্ষ তরফে মন্দিরে বেঁধে দেওয়া হয়েছে বাঁশের ব্যারিকেট গেটে ঝুলছে তালা। ভীড় এড়াতে নামানো হয়েছে পুলিশ ফোর্স । পুরোহিত থেকে গ্রামবাসীসহ পুরোএলাকা জুড়ে এখন বিষাদের ছায়া ।
প্রবীণদের মতে , জীবনের এত গুলো বছর অতিবাহিত করেও শিবের গাজন বন্ধ হতে দেখিনি । কিন্তু আজ দেখলাম ।
Social Plugin