দুই বাংলা মিলে দেড়শ বছরের মাধাইখালী কালীর মেলা

শুভাশিস দাশ 


কাঁটাতার যে শুধুই বাইরের আবরণ তা আমরা বারে বারে প্রমাণ পাই । মনের জমির উপর কেউ কোন বেড়া দিতে পারেনি কোনদিন । বিশেষ করে বাংলদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতির আবহে গড়ে ওঠা ধর্মীয় সামাজিক সাংস্কৃতিক আচার অনুষ্ঠান গুলোকে কেন্দ্র করে এই দুই বঙ্গে । এই অস্থির সময়ে যখন মানুষে মানুষে হানাহানি , ধর্মের উন্মাদনার আগুনে দেশ জ্বলছে ঠিক এই সময়ে আমরা সম্প্রীতির মেল বন্ধন খুঁজে পাই কোচবিহারের দিনহাটার সীমান্তবর্তী গ্রাম বামনহাটের মাধাইখালী কালী পুজোয় এবং এই পুজোকে কেন্দ্র করে আয়োজিত সম্প্রীতির মেলা কে ঘিরে । 

আমাদের সমাজ জীবনে মেলার একটা আলাদা আবেদন আছে ,সে যে মেলাই হোক না কেন আর বঙ্গ জীবন? এই মেলা বাঙালিদের এক অন্যতম সেন্টিমেন্ট বয়ে আনে l

আমাদের শহুরে জীবনের সাথে মেলা যেভাবে জড়িয়ে থাকে তার থেকে অনেক বেশি জড়িয়ে থাকে গ্রামীণ জীবনে l

আর যে কারণে শহরের চাইতে উত্তরবঙ্গে গ্রামীণ মেলা গুলো বেশি জনপ্রিয় l 

উত্তরের মেলা গুলোর মধ্যে দিনহাটা মহকুমার বামনহাট অঞ্চলের পাথরশনের মা মাধাই খালীর মেলা একটি অন্যতম মেলা l দিনহাটা মহকুমার বামনহাট অঞ্চলের পাথরশন এলাকায় বিশাল আকারের কালী মাকে ঘিরে এই মেলা l

কথিত আছে এই মাধাই খালী কালী মা ওপার বাংলা থেকে এসেছেন l ওপারের কুড়িগ্রামের লবণ খাওয়া গ্রামে এই মাতৃ মূর্তির পুজো ও মেলা হতো l জানা যায় আজ থেকে প্রায় সাড়ে ছয় দশক আগে জনৈক ব্রাহ্মণ এপারে এসে সেই মাতৃ মূর্তি এপার বাংলার পাথরসনে এসে এই পুজো শুরু করেন l 

বামনহাটে কোন মাধাইখাল নামে জায়গা  নেই l ওপারের কুড়িগ্রামের লবণখাওয়া গ্রামে মাধাইখাল নামে একটি কালীর মেলা হতো l জানা যায় সেই জায়গার আস পাশে ছিল অনেক ছোট ছোট খাল এবং তার পাশেই এই মায়ের মন্দির ছিল l আর সেই মন্দিরের মা কালী মাধাইখালী নামে  পরিচিত ছিল । দুই বাংলা মিলে এই কালী পুজিতা হয়ে আসছেন প্রায় দেড়শ বছর । 

১৯৫২ সালে এপারের পাথরশণে স্থানীয় মানুষদের সহযোগিতায় মায়ের পুজো শুরু হয় l ' মাধাইখাল ' নাম ওপার থেকে আসা সেই ব্রাহ্মণ পূজারির দেয়া বলে অনেকে মনে করেন l 

প্রথম দিকে একটা ছোট খড়ের ছাউনি দেয়া মন্দির বানিয়ে সেই ব্রাহ্মণ পুজো শুরু করেন । পরে গ্রামবাসীদের সহযোগীতায় মন্দিরের সংস্কার হয় । দিনহাটা এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের ভক্তপ্রাণ মানুষজনের বিশ্বাস এই দেবীর কাছে চাইলে তিনি মনের বাসনা পূরন করেন । এই বিশ্বাস ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে । আজ এই দেবীর পুজোকে ঘিরে যে আবেগ উন্মাদনা তা এই বিশ্বাস থেকেই জন্মেছে বলে অনেকের ধারণা । 

এই পুজোকে কেন্দ্র করে যে মেলা বসে তাতে দুই বাংলার মানুষ মিলিত হন এই মেলায় l কাঁটা তার উপেক্ষা করে অনেকেই আসেন ওপারের উত্তরাঞ্চল থেকে l

বামনহাটের এই কালী পুজো হয় অষ্টমী স্নানের সাত দিন পর প্রথম শনিবার বা মঙ্গলবারে l পুজোর সাত দিন পর দেবীর উদ্দেশ্যে এখানে মহিষ বলি দেয়া হয় l এছাড়া এখানে পাঁঠা ,কবুতরও বলি দেন ভক্তরা l

বিশাল আকার দেবী মূর্তি এখানে পুজিতাহলেও ছোট ছোট মন্দিরে রয়েছে শীতলা ,মাসানবাবা ,শ্রী হরি ঠাকুরের l এছাড়া এখানে পাগলাপীরের পুজোও হয়ে থাকে l


এবার মেলা শুরু হবে  ১ এপ্রিল থেকে ।

বার্ষিক পুজো চৈত্রে অনুষ্ঠিত হলেও বছর ভর এখানে নিত্য পুজো হয় । প্রতি শনি ও মঙ্গলবার বিশেষ পুজো এবং ভক্তদের মানসিক করা পুজোর পশু বলি দেবার ব্যাবস্থা আছে । 

উত্তরবঙ্গের জনমানসে এই মেলা একটা জায়গা করে আছে শুধু উত্তর নয় নিম্ন অসম এবং বাংলদেশের উত্তর অংশের কুড়িগ্রাম , লালমনিরহাট জেলার বহু ভক্ত প্রাণ মানুষজন এই মেলায় আসেন । 
ধরলা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেলেও অনেক সামাজিক ,রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলেও মেলার জৌলুস এতটুকুও কমে নি l এই মেলাকে কেন্দ্র করে দুই উত্তর এক হয়ে যায় সেখানে কাঁটাতার বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় না l