ডায়াবেটিস : নি: শব্দ মৃত্যুর হাতছানি
ডায়াবেটিস : নি: শব্দ মৃত্যুর হাতছানি
ডা: অজয় মন্ডল
(এম বি বি এস (ক্যালকাতা ) পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা ইন ডায়াবেটিস ( ইউ কে ) পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা ইন কার্ডিওলজি( ইউ কে ) কনসালট্যান্ট ফিজিসিয়ান , হার্ট এবং সুগার অভিজ্ঞ)
সুগার হলো সাইলেন্ট কিলার । আপনি কিভাবে নি:শব্দে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন সেটা বুঝতেই পারবেন না । তাই ডায়াবেটিসের নির্নয় তাড়াতাড়ি করা উচিত ।
শরীর যখন রক্তের সব চিনিকে (গ্লুকোজ) ভাঙতে ব্যর্থ হয়, তখনই ডায়াবেটিস হয়। এই জটিলতার কারণে মানুষের হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক , কিডনি ফেলিওরের মতো জটিল রোগ হতে পারে।
এছাড়াও ডায়াবেটিসের কারণে মানুষ অন্ধ হয়ে যেতে পারে, নষ্ট হয়ে যেতে পারে কিডনি এবং অনেক সময় শরীরের নিম্নাঙ্গ কেটেও ফেলতে হতে পারে।
সারা বিশ্বেই এই সমস্যা বেড়ে চলেছে। বর্তমানে সারা বিশ্বে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৫৬ কোটিরও বেশি।
চিকিৎকরা বলছেন, ডায়াবেটিসের এতো ঝুঁকি থাকার পরেও যতো মানুষ এই রোগে আক্রান্ত তাদের অর্ধেকেরও বেশি এই রোগটি সম্পর্কে সচেতন নয়।
তবে জীবন যাপনের ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম নীতি মেনে চললে অনেক ক্ষেত্রে ডায়াবেটিসকে প্রতিরোধ করা সম্ভব।
ডায়াবেটিসের কারন :
আমরা যখন কোন খাবার খাই তখন আমাদের শরীর সেই খাদ্যের শর্করাকে ভেঙে চিনিতে (গ্লুকোজ) রুপান্তরিত করে। অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন নামের যে হরমোন নিসৃত হয়, সেটা আমাদের শরীরের কোষগুলোকে নির্দেশ দেয় চিনিকে গ্রহণ করার জন্যে। এই চিনি কাজ করে শরীরের জ্বালানী বা শক্তি হিসেবে।
শরীরে যখন ইনসুলিন তৈরি হতে না পারে অথবা এটা ঠিক মতো কাজ না করে তখনই ডায়াবেটিস হয়। এবং এর ফলে রক্তের মধ্যে চিনি জমা হতে শুরু করে।
ডায়াবেটিসের প্রকারভেদ :
ডায়াবেটিস দুই ধরনের হয় ।
type 1 ও type 2
type -1 ডায়াবেটিসে অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। তখন রক্তের প্রবাহে গ্লুকোজ জমা হতে শুরু করে।
বিজ্ঞানীরা এখনও বের করতে পারেন নি কী কারণে এরকমটা হয়। তবে তারা বিশ্বাস করেন যে এর পেছনে জিনগত কারণ থাকতে পারে। অথবা অগ্ন্যাশয়ে ভাইরাসজনিত সংক্রমণের কারণে ইনসুলিন উৎপাদনকারী কোষগুলো নষ্ট হয়ে গেলেও এমন হতে পারে।
যাদের ডায়াবেটিস আছে তাদের ১০ শতাংশ এই type -1 এ আক্রান্ত।
অন্যটি হলো type -2 ডায়াবেটিস। এই ধরনের ডায়াবেটিসে যারা আক্রান্ত তাদের অগ্ন্যাশয়ে যথেষ্ট ইনসুলিন উৎপন্ন হয় না অথবা এই হরমোনটি ঠিক মতো কাজ করে না।
সাধারণত মধ্যবয়সী বা বয়স্ক ব্যক্তিরা type-2 ধরনের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। বয়স কম হওয়া সত্ত্বেও যাদের ওজন বেশি এবং যাদেরকে বেশিরভাগ সময় বসে বসে কাজ করতে হয় তাদেরও এই ধরনের ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
বিশেষ কিছু এলাকার লোকেরাও এই ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে আছে। তার মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়া।
সন্তানসম্ভবা হলে পরেও অনেক নারীর ডায়াবেটিস হতে পারে। যাকে বলে gestational diabetes . তাদের দেহ থেকে যখন নিজের এবং সন্তানের জন্যে প্রয়োজনীয় ইনসুলিন যথেষ্ট পরিমানে তৈরি হতে না পারে, তখনই তাদের ডায়াবেটিস হতে পারে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে ৯থেকে ১৮ শতাংশ গর্ভবতী নারীর ডায়াবেটিস হতে পারে। ডায়েট, শরীর চর্চা অথবা ইনসুলিন নেওয়ার মাধ্যমে তাদের শরীরে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা গেলে তাদের type -2 ধরনের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব।
ডায়াবেটিসের লক্ষন সমুহ :
* খুব তৃষ্ণা পাওয়া
* স্বাভাবিকের চাইতেও ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া। বিশেষ করে রাতের বেলায়।
* বারে বারে ক্ষুধা পাওয়া
* ক্লান্ত বোধ করা
* কোন কারণ ছাড়াই ওজন কমে যাওয়া
* প্রদাহজনিত রোগে বারবার আক্রান্ত হওয়া
* দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাওয়া
* শরীরের কোথাও কেটে গেলে সেটা শুকাতে দেরি হওয়া
type-1 ডায়াবেটিসের লক্ষণ শৈশব থেকেই দেখা দিতে পারে এবং বয়স বাড়ার সাথে সেটা আরো জটিল হয়ে উঠতে পারে।
বয়স ৪০ বছরের বেশি হওয়ার পর থেকে type-2 ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তবে দক্ষিণ এশিয়ার লোকজনের মধ্যে এই ঝুঁকি তৈরি হয় তাদের ২৫ বছর বয়স হওয়ার পর থেকেই।
যাদের পিতামাতা, ভাই বোনের ডায়াবেটিস আছে, অথবা যাদের অতিরিক্ত ওজন, দক্ষিণ এশিয়ার কোন দেশের মানুষ, আফ্রো-ক্যারিবিয়ান অথবা কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান তাদেরও এই ঝুঁকি বেশি থাকে।
ডায়াবেটিস কি প্রতিরোধ করা সম্ভব?
ডায়াবেটিস যদিও জেনেটিক এবং আপনার জীবন যাপনের স্টাইলের ওপর নির্ভরশীল তারপরেও আপনি চেষ্টা করলে রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে পারেন।
সেজন্যে আপনাকে খাবার গ্রহণের বিষয়ে বিশেষভাবে সচেতন থাকতে হবে। প্রক্রিয়াজাত খাবার ও ক্ষতিকারক পানীয় যেমন মদ , কোল্ড ড্রিংকস , এনার্জী ড্রিংকস এড়িয়ে চলতে হবে। মসৃন সাদা আটার রুটির পরিবর্তে খেতে হবে ভুষিওয়ালা আটার রুটি। এটাই প্রথম ধাপ।
এড়িয়ে চলতে হবে হোয়াইট পাস্তা, প্যাস্ট্রি, ফ্রিজি ড্রিংকস, চিনি জাতীয় পানীয়, মিষ্টি ইত্যাদি।
আর স্বাস্থ্যকর খাবারের মধ্যে রয়েছে শাক সব্জি, ফল, বিন্স এবং মোটা দানার খাদ্য শস্য।
মেনুতে ভাতের পরিমান কমিয়ে আলু ছাড়া তরকারীর পরিমান বাড়িয়ে দিতে হবে ।
স্বাস্থ্যকর তেল, বাদাম খাওয়াও ভালো। ওমেগা থ্রি তেল আছে যেসব মাছে সেগুলো বেশি খেতে হবে। যেমন সারডিন, স্যামন এবং ম্যাকেরেল।
এক বেলা পেট ভরে না খেয়ে পরিমানে অল্প অল্প করে বিরতি দিয়ে খাওয়া দরকার।
শরীর চর্চ্চা বা ব্যায়াম করার মাধ্যমে রক্তে চিনির মাত্রা কমিয়ে রাখা সম্ভব।
চিকিৎসকরা বলছেন, প্রতি সপ্তাহে আড়াই ঘণ্টার মতো ব্যায়াম করা দরকার। তার মধ্যে দ্রুত হাঁটা এবং সিড়ি বেয়ে ওপরে ওঠাও রয়েছে।
ওজন কম রাখলেও চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। যদি ওজন কমাতে হয় তাহলে সেটা ধীরে ধীরে করতে হবে। সপ্তাহে আধা কেজি থেকে এক কেজি পর্যন্ত।
ধূমপান পরিহার করাও জরুরী। নজর রাখতে হবে কোলস্টেরলের মাত্রার ওপর। এর মাত্রা বেশি হলে হৃদ রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
ডায়াবেটিসের কারণে কী ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে?
রক্তে চিনির পরিমাণ বেশি হলে রক্তনালীর মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।
শরীরে যদি রক্ত ঠিক মতো প্রবাহিত হতে না পারে, যেসব জায়গায় রক্তের প্রয়োজন সেখানে যদি এই রক্ত পৌঁছাতে না পারে, তখন স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
এর ফলে মানুষ দৃষ্টি শক্তি হারাতে পারে। ইনফেকশন হতে পারে পায়ে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, অন্ধত্ব, কিডনি নষ্ট হয়ে যাওয়া, হার্ট অ্যাটাক, নার্ভের সমস্যা ,ডায়াবেটিক ফুট আলসার , স্ট্রোক ইত্যাদির পেছনে একটি বড় কারণ হলো ডায়াবেটিস।
চিকিৎসা :
বর্তমান সময়ে ডায়াবেটিসের অনেক উন্নত চিকিৎসার উদ্ভাবন হয়েছে । অনেক নুতন নুতন মেডিসিন আবিষ্কার হয়েছে । ইনসুলিনের প্রয়োগ সঠিক ভাবে করা সম্ভব হচ্ছে । যদি চিকিৎসা পদ্ধতির সাথে সাথে ডায়েট মডিফিকেসন ও শারিরিক চর্চা ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী করা যায় সুগার নিয়ন্ত্রনে থাকেক। আর সুগার নিয়ন্ত্রনে থাকলে সুগারের যেসব মারাত্মক শারীরিক জটিলতা হতে পারে সেগুলো থেকে রক্ষা পাওয়া যায় । তাই সুগার নিয়ে ভয় পাওয়ার কোনো দরকার নেই । ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলুন সুগার কে পর্যুদস্ত করুন ।
