বিদ্যাসাগর আজও একাই রয়ে গেলেন !
বিদ্যাসাগর আজও একাই রয়ে গেলেন !
সম্রাট দাস
দ্রোনাচার্য যখন অস্ত্রশিক্ষা দিচ্ছিলেন কৌরব ও পাণ্ডবদের – তখন গাছের ডালে একটি কাঠের পাখির দিকে তীর ছোড়ার আগে দ্রোনাচার্য সবাই কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন – তোমরা কী দেখতে পাচ্ছ ? কেউ বলেছিল গাছের ডাল এবং পাখি, কেউ বা শুধু পাখিটাকে । কিন্তু একমাত্র অর্জুন বলেছিলো সে পাখিটির চোখ দেখছে শুধু । গল্পটা প্রায় সবাই জানে । তবু আরেকবার বলতে হলো নারী সমাজের উন্নয়নে বিদ্যাসাগরের অবদানের গুরুত্বকে পুনর্মূল্যায়ন করতে গিয়ে ।
শুধু বর্তমান সমাজে নয় – আদিকাল থেকেই নারীকে ভোগ্য বস্তুই মনে করা হয়েছে । পুরুষের অধীনতাই নারীর যেন একমাত্র অবলম্বন । বাল্যে পিতার অধিনে, যৌবনে স্বামীর অধীনে আর বয়সকালে পুত্রের অধীনে – এই হোলও নারীর জীবন । নিজের বলে কিছুই ছিলোনা সেদিন এবং বর্তমান শতকেও । তসলিমা নাসরিনের ভাষায় –
‘নারীর কোন দেশ নাই।’
পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা সর্বদা আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে নারীকে । পায়ে পড়িয়েছে শেকল – কপালে সেঁটে দিয়েছে নিশান – অধিকারের চিহ্ন ।
কিন্তু সব মানুষই তো আর সমান হয় না! ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় তেমনি এক মানুষ । একরোখা – জেদি বীরসিংহের এই সিংহ শিশু । রামমোহন যখন সতীদাহ প্রথা বন্ধ করলেন – তখন সমাজে বিধবাদের পুনর্বিবাহ করালেন বিদ্যাসাগর । আর কোন কৃতিত্বের কথা না জানলেও এই একটিমাত্র পরিচয়েই তিনি আমাদের কাছে পরিচিত । বিধবাদের আবার বিয়ে দেওয়া যায় এবং তা আইনসিদ্ধ – এইটুকুই তো আমাদের প্রয়োজনের । এই প্রয়োজনের বাইরে দেখতে চাইনি কিছুই ।
বিদ্যাসাগর মহাশয় শুধু কি বিধবাদের বিয়ে দিয়ে তাদের নিরাপত্তা বিধান করতে চেয়েছিলেন ? নাকি বিধবাদের সমস্ত যন্ত্রণা, অবহেলার হাত থেকে মুক্ত করার জন্য তিনি তৎকালীন পুরুষতান্ত্রিক সমাজকে পাল্টাতে চেয়েছিলেন ? শুধুই বিধবাদের বিয়ে নাকি সমস্ত অবহেলার হাত থেকে বিধবাদের মুক্ত করার জন্য একটা আলোড়ন ফেলতে চেয়েছিলেন পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বুকে ?
যিশু যেমন নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন মানবসমাজের জন্য – বিদ্যাসাগরও নিজের জীবনকে নিংড়ে দিলেন নারীর দুঃখ দূর করার জন্য ।অথচ সমকাল তাকে বুঝলোনা যেমন আজও হয়ত আমরা তাকে বুঝিনি । বিধবাকে বিবাহের নাম করে বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে আর্থিক বরাদ্দ প্রাপ্তিটাই মূল হয়ে উঠেছিল । আর যার জন্য বিদ্যাসাগরের নিজের সঞ্চিত অর্থ শেষ করে বাজারে ঋণ ৮৭০০০ টাকা । যাদের অনুপ্রেরণায় বিধবা বিবাহের কর্মে বিদ্যাসাগর যোগদান করেছিলেন একটা সময় তারাই পাল্টি খেল । মর্মান্তিকভাবে আহত হলেন বিদ্যাসাগর । জানালেন –
‘আমাদের দেশের লোক এত অসার ও অপদার্থ বলিয়া পূর্বেব জানিলে আমি কখনই বিধবা বিবাহ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিতাম না । তৎকালে সকলে যেরূপ উৎসাহ প্রদান করিয়াছিলেন তাহাতে আমি সাহস করিয়া এ বিষয়ে প্রবৃত্ত হইয়াছিলাম নতুবা বিবাহ ও আইন প্রচার পর্যন্ত করিয়া ক্ষান্ত থাকিতাম ।’
শুধু তাই নয় – জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে তিনি আক্ষেপ করে বললেন –
‘দেশহিতৈষী সৎকর্ম্মোৎসাহী মহাশয়দিগের বাক্যে বিশ্বাস করিয়া ধনেপ্রাণে মারা পড়িলাম ।’
সত্যিই কি মর্মান্তিক এই পরিনতি ! বিদ্যাসাগরের মতন বীর সাহসী মানুষও শেষ পর্যন্ত দীর্ঘশ্বাস ফেললেন । যে সমাজের সমস্ত বাঁধাকে হেলায় উপেক্ষা করে সংসারের সমস্ত সুখ জলাঞ্জলি দিয়ে বিধবা নারীদের দুঃখ দূর করার জন্য ঝাপিয়ে পড়লেন সেই মানুষই কিনা বলতে বাধ্য হলেন ‘......কখনই বিধবা বিবাহ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিতাম না ।’ কতটা অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়লে বিদ্যাসাগরের মতন মানুষ ও এমন কথা বলতে বাধ্য হন ।
বিধবা বিবাহ আইন সিদ্ধ হল ঠিকই – কিন্তু সমাজ কিন্তু সেদিন বিধবা বিবাহ কে মনথেকে গ্রহণ করতে পারলেন না । যারাও বা বিধবা নারীকে বিবাহ করলেন তাদের অধিকাংশই কিন্তু অর্থের লোভে পড়ে । অশোক কুমার মিশ্র তার ‘বিধবা বিবাহ ও বাংলা কবিতা’ গ্রন্থে প্রসঙ্গত বলেছেন –
‘বিধবা বিবাহের মূল উদ্দেশ্য বিধবার দুঃখ মোচন – নূতন করে বিধবাকে সংসারে প্রতিষ্ঠিত করে দেওয়া । কিন্তু কিছু সংখ্যক ব্যবসায়ী বুদ্ধি সম্পন্ন প্রতারক অর্থের লোভে একাধিক বিধবার পাণিগ্রহন করতে লাগল ।’
বাঙালী সমাজ সেদিন সত্যিই মানুষ হতে পারেননি । হীনমন্য বাঙালী সমাজ শুধু স্বার্থটাই দেখে গেছে । বিধবা নারীদেরকে – তাদের যন্ত্রণাকে বোঝার চেষ্টা বিন্দুমাত্র করেনি ।
কিন্তু আজ ! আধুনিক পেরিয়ে উত্তর আধুনিকে যাত্রা করছে যে বাঙালী সমাজ – তারাও কি পেরেছে বিধবা নারীদের যন্ত্রণাকে একটু বুঝতে ? তাদের কে মানুষ হিসাবে ভাবতে ? আজও কি মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে বিধবা নারীদের অবাধ যাতায়াতে স্বীকৃতি দিয়েছে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন সমাজ ? বিধবা নারীকে শুধু মানবী হিসাবে ভাবতে পেরেছে কী বর্তমান সমাজ ? - এত প্রশ্নের একটাই উত্তর - না ।
তাহলে বিদ্যাসাগর মহাশয় যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তা কী একপ্রকার ব্যর্থ নয় ? বিধবা নারীদের দুঃখ মোচনে তাঁর উদ্দেশ্য তো মুখ থুবরে পড়ে আছে । আসলে সমকাল যেমন বিদ্যাসাগরকে বুঝতে পারেনি – বর্তমান কালও তাকে বুঝতে চায়না । মহাভারতের অর্জুনের মতন দৃষ্টি খুব কম মানুষেরই রয়েছে । যার জন্য আমরা শুধু বিধবা বিবাহ প্রচলনের বাইরের উদ্দ্যেশটাই লক্ষ্য করেছি । বিধবা নারীকে শুধু মাত্র পুরুষের আশ্রয় দেওয়ার কথাই বুঝেছি । তাদের যন্ত্রণা – তাদের প্রতি অবহেলা, লাঞ্ছনা–র হিসাব কেউ রাখতে যাইনি কোনদিন । বিদ্যাসাগর তাঁর সমকালে যেমন একলা ছিলেন – আজও তেমনি একলাই রয়ে গেছেন ।
তথ্যঋন গ্রহণঃ১) বিধবা বিবাহ ও বাংলা কবিতা / অশোক কুমার মিশ্র
২) বিদ্যাসাগর চরিত/ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৩) বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ / বিনয় ঘোষ
৪) বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব / শ্রী ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা
0 মন্তব্যসমূহ
Thank you so much for your kindness and support. Your generosity means the world to me. 😊