Latest News

6/recent/ticker-posts

Ad Code

ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের মহাপ্রয়াণে এক অনন্য স্মৃতিকথা — কলমে ড. শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

স্বর্ণকণ্ঠশিল্পী ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের চিরবিদায় স্মরণে 

ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, শিল্পী ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের স্মৃতিকথা, ড. শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, পান্নালাল ভট্টাচার্য, বাংলা সংগীতের স্বর্ণযুগ, শ্যামাসংগীত সম্রাট, প্রফুল্ল ভট্টাচার্য, সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ ভাদুড়ী, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের প্রয়াণ দিবস, বাংলা আধুনিক গান, নজরুল গীতি, বালি ভট্টাচার্য পরিবার।

ড.শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় 

যে সময় তাঁকে গড়ে তুলেছিল, সেই সময় অতীত হয়েছে বহুদিন। তবু বাংলা সংগীত আকাশে আজও তিনি উজ্জ্বল। একান্ত নিজস্বতায়। বাংলা সংগীতের স্বর্ণযুগের সেই স্বর্ণকণ্ঠশিল্পী ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের প্রয়াণ নিয়ে স্মৃতিকথা লিখলেন তাঁরই অগ্রজ - সুরকার প্রফুল্ল ভট্টাচার্যের দৌহিত্র ডঃ শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়।

১৯৯২। জীবনের শেষ প্রান্তে তখন তিনি উপনীত। তাঁর সংগীত জীবন তখনও উজ্জ্বল বাংলা সংগীতের জগতে সুবর্ণজয়ন্তীর বর্ণবৈভবে। কালের কণ্ঠ তখন তাঁরও কণ্ঠে। এ সেই কণ্ঠ - যে কণ্ঠে ধরা দেয় অতীত, আগামীকে অতিক্রম করে। তবু সমকালে ছিল তাঁর গভীর আস্থা, তাই সংগীতের ধারার সরস্বত উত্তরাধিকার রেখে যেতেও বদ্ধপরিকর ছিলেন তিনি। সেই উত্তরাধিকার বহন করেছিলেন তাঁর কাছ থেকে যাঁরা সংগীতের শিক্ষা নিয়েছিলেন - তাঁরা তো বটেই, তাঁর সুপুত্র দীপঙ্কর ভট্টাচার্যও। কিন্তু তাঁর জীবনের পরিণতির পর্বে প্রতিমুহূর্তে কথা বলেছে যে শ্রদ্ধা, ভক্তি, সমর্পণ - সেই পর্বই তাঁর জীবনের শেষ পর্বে হয়ে উঠেছিল ধ্রুবপদ। সেখানে তিনি অভিনেতা, সুরকার, গীতিকার, কিংবা সংগীত সাধক নন - একজন সাধক। তাই জীবনের শেষ পর্বে প্রণামও নিতে চাইতেন না তিনি। বলতেন, প্রণাম শুধু একজনকেই করা যায় - তিনি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ। আবার ইনিই যখন আত্মমগ্ন হয়ে মায়ের পুজোয় ডুব দিতেন তখন প্রায়ই দেখা যেত এক আশ্চর্য স্বর্গীয় আলো এসে পড়ছে তাঁর ওপর। সে এক অলৌকিক বিষয়।

"The Levitating Saint" নামে যিনি বিশ্ববন্দিত সেই ভাদুড়ী মহাশয় অর্থাৎ যোগাচার্য পরমহংস মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ - নগেন্দ্রনাথ ভাদুড়ী ছিলেন তাঁদের পূর্বপুরুষ। মহর্ষি নগেন্দ্রনাথের পরমার্থ সংগীতের মুগ্ধ শ্রোতা ছিলেন স্বয়ং রামকৃষ্ণদেব। এই মহান যোগী পরমহংস মহর্ষি নগেন্দ্রনাথের ভাইপো ছিলেন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের পিতা সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। পৌরোহিত্য করার জন্য, মতান্তরে বর্ধমান রাজপরিবার থেকে এই বংশ 'ভট্টাচার্য' উপাধি পায়। এঁরা ছিলেন হাওড়া জেলার পায়রাটুঙির সম্পন্ন জমিদার। পরে অবশ্য সুরেন্দ্রনাথ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মতান্তরের কারণে বালি চলে আসেন।

ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের কনিষ্ঠ ভ্রাতা - সাধক শিল্পী পান্নালাল ভট্টাচার্য যখন মাতৃ জঠরে তখনই অকালে প্রয়াত হন সুরেন্দ্রনাথ। সেই কঠিন সময়ের ঘেরাটোপে দাঁড়িয়েও স্বামী সুরেন্দ্রনাথের পারিবারিক জমিদারিতে ফিরে যাননি অন্নপূর্ণা। তারপর অবশ্য ধীরে ধীরে সময়ের চাকা ঘোরে। সুরকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান আমার দাদু প্রফুল্ল ভট্টাচার্য। আর শচীন দেববর্মন, কুন্দনলাল সায়গল, কৃষ্ণচন্দ্র দের মতো নক্ষত্রদের পাশাপাশি ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন মেজ দাদু - ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য। হয়ে উঠেন বাংলা সংগীতের ধারার সংগীত সম্রাট। পরবর্তীতে এই দুই দাদার প্রচেষ্টা এবং উৎসাহেই আমার ছোট দাদু পান্নালাল ভট্টাচার্য হয়ে ওঠেন শ্যামা সংগীতের ধারায় জীবন্ত কিংবদন্তি।

মেজ দাদু পড়াশুনো করেছিলেন রিভার্স টমসন স্কুলে। পরে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির নাম হয় শান্তিরাম স্কুল। সেকালে এই রিভার্স টমসন স্কুলের যথেষ্ট সুনাম ছিল। স্থানীয় এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের পড়ুয়াদের ভিড়ে সরগরম থাকত এই স্কুল। এই স্কুলের ছাত্র হিসেবে মেজ দাদু ছিলেন বরাবরই মেধাবী। উজ্জ্বল ছাত্র। পরীক্ষায় বরাবর ফার্স্ট, না হয় সেকেন্ড হতেন।  পরবর্তীতে যখন তিনি সংগীতের জগতে আত্মপ্রকাশ করলেন তখনও সেই উজ্জ্বল আলো তাঁকে ছেড়ে যায়নি। বরং সংগীত শিল্পী হিসেবে তাঁর জনপ্রিয়তা ফেলে আসা সময়ের বৃত্তে বারবার আকাশ ছুঁয়েছে।

স্কুলেরই বার্ষিক অনুষ্ঠানে একক গেয়েছিলেন ছোট্ট ধনঞ্জয়— ‘পাগলা মনটারে তুই বাঁধ’ এবং ‘ভাইয়ের দোরে ভাই কেঁদে যায়’। দর্শকের আসনে বসে সেই গান শুনতে শুনতে মুগ্ধ হয়েছিলেন অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। গায়ক-বালককে তিনি পুরস্কৃত করেছিলেন পাঁচ টাকার একটি নোট দিয়ে।

সংগীত ছিল এই পরিবারের রক্তে। মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ থেকে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র  ধ্যানপ্রকাশ ব্রহ্মচারী এবং সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের শাস্ত্রীয় সংগীতে অসামান্য দক্ষতা ছিল। সুরেন্দ্রনাথের হাতে সেতার আর এস্রাজ সুরে সুরে জীবন্ত হয়ে উঠত। সেই উত্তরাধিকার বহন করেছিলেন মেজ দাদুও। সেই প্রতিভার পরিচয় পেয়েই স্কুলের সুধাংশু স্যার মেজ দাদুর সংগীত শিক্ষার ব্যবস্থা করেন। পরবর্তী সময়ে সেতারশিল্পী গোকুল নাগ ও উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতশিল্পী সত্যেন ঘোষালের তালিম তাঁকে পূর্ণতা প্রদান করে। এক্ষেত্রে সুবল দাশগুপ্ত, কমল দাশগুপ্ত, শৈলেশ দত্তগুপ্তের ভূমিকাও কম নয়।

মেজ দাদুর গাওয়া 'যদি ভুলে যাও মোরে, জানাব না অভিমান’ - এই গানটি তো সেই সময় জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছে গিয়েছিল। ‘আমায় তুমি ভুলতে পারো/ কেমন করে ভুলবে আমার গান’, ‘আমি চেয়েছি তোমায়’, ‘দোলে শালপিয়ালের বন’, ‘কবির খেয়ালে’, ‘মাটিতে জন্ম নিলাম’, ‘রুমা ঝুমা ঝুম’, ‘ঝনন ঝনন বাজে’, ‘এই ঝির ঝির বাতাসে’ তো আজও শ্রোতাদের মুগ্ধ করে। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায়, আমার দাদু প্রফুল্ল ভট্টাচার্যের সুরে ‘বাসরের দীপ’ কিংবা শ্যামল গুপ্তের কথায়, আমার দাদু প্রফুল্ল ভট্টাচার্যের সুরে ‘হৃদয়ে মোর রক্ত ঝরে’ আজ এই সময়ের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়েও বারবার শুনি। আর 'তিলেক দাঁড়া ওরে শমন', 'মা মা বলে আর ডাকব না', 'মুক্ত কর মা মুক্তকেশী' কিংবা মেজ দাদুর সুর করা, ছোট দাদুর গাওয়া ‘অপার সংসার, নাহি পারাপার’ তো যতোবার শুনি ততোবারই যেন নতুন নতুন উপলব্ধির জগতে পৌঁছে যাই। 

আবার ছোট দাদু পান্নালাল ভট্টাচার্যের অকাল প্রয়াণের পর মেজ দাদুর ‘পান্নালাল স্মরণে’ রেকর্ড করা দুটি গান - ‘থির হয়ে তুই বস দেখি মা’ এবং ‘ত্রিভুবন জয় করিয়া রাবণ’ আজও যখনই শুনি তখনই আমার দুচোখ জলে ভরে ওঠে। দুটি গানই মেজ দাদুর নিজের লেখা। সুর করেছিলেন আমার দাদু প্রফুল্ল ভট্টাচার্য। পুত্রসম ছোট ভাইয়ের অকালে চলে যাওয়ার স্মৃতিতে এ এক অনন্ত বেদনার নিরবচ্ছিন্ন পথ চলা...

বহুজনের কাছে বহুবার শুনেছি - রেডিওতে শনিবার দুপুরের অনুরোধের আসর অসম্পূর্ণ থেকে যেত তাঁর গান ছাড়া। বাংলা সংগীতের জগতে তখন ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর বলা হত জগন্ময় মিত্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যকে। বাংলা আধুনিক গান, নজরুলগীতি, শ্যামাসংগীত, উচ্চাঙ্গ সংগীত — সবেতেই মেজ দাদুর রেওয়াজি কণ্ঠের চলনের দক্ষতা ছিল অবিস্মরণীয়। রবীন্দ্র সংগীতের ক্ষেত্রেও তাঁর পারদর্শিতা ছিল। উজ্জ্বলা সিনেমায় শ্যামা নৃত্যনাট্যের আয়োজনে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্রের সঙ্গে গান গেয়েছিলেন মেজ দাদুও। তাঁর গাওয়া উত্তীয়ের গানগুলি শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন স্বয়ং কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়।

৯২-এর মার্চে মেজ দাদু শ্রীরামপুরে যান এক ভক্তিমূলক সংগীতের আসরে। ডায়াবেটিক নেপ্রোপ্যাথি তখন বাসা বেঁধেছে মেজ দাদুর শরীরে। ১৮ ডিসেম্বর কলেজ স্ট্রিটের বাড়ি ছেড়ে মেজ দাদু ভর্তি হলেন উত্তর কলকাতার এক নার্সিংহোমে। ২৩ ডিসেম্বর থেকে কোমায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন তিনি। তারপর ডিসেম্বরের ২৭। নিভে গেল জীবন জ্যোতি। চলে গেলেন বাংলা সংগীতের চিরকালের স্বর্ণ কণ্ঠশিল্পী।

আমি তখন অনেকটাই ছোট, তবু ফেলে আসা সেই দিনের শেষ যাত্রার সেই সব ছবি এখনও মনে পড়ে। দুচোখ ভরে ওঠে জলে। তবু মনে হয় এখনও গান গাইছেন মেজ দাদু। একটু পরেই প্রণাম করবো আমি। আমার মাথার উপর পড়বে তাঁর হাতের স্নেহ আর আশীর্বাদ ভরা কোমল স্পর্শ...

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Ad Code