Afrin Jabi : মেদিনীপুরের মেয়ে আফরিন জাবির ঐতিহাসিক ইংলিশ চ্যানেল জয়
পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর শহরের ২১ বছর বয়সী তরুণী আফরিন জাবি (Afrin Jabi) সম্প্রতি যে অসামান্য কীর্তি স্থাপন করেছেন, তা শুধু তাঁর ব্যক্তিগত সাফল্য নয়, ভারতের দীর্ঘ-দূরত্বের সাঁতারের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। কিংবদন্তি সাঁতারু বুলু চৌধুরীর প্রদর্শিত সাহসিকতার পথ অনুসরণ করে, এই তরুণী ইংলিশ চ্যানেল সাঁতরে পার হয়ে দেখিয়েছেন যে অধ্যবসায় এবং কঠোর অনুশীলনের মাধ্যমে যেকোনো অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়।
আফরিন জাবির (Afrin Jabi) ঐতিহাসিক সাঁতার শুরু হয়েছিল ২৫শে জুলাই, ২০২৫ তারিখে। সেই দিন সকাল ৭টা ৪৫ মিনিটে (ভারতীয় সময়) তিনি ইংল্যান্ডের ডোভার থেকে তাঁর যাত্রা শুরু করেন। এটি ছিল প্রায় ৩৪ কিলোমিটার দূরত্বের একটি একক পথ, যা তাঁকে ডোভার থেকে উত্তর ফ্রান্সের ক্যাপ-গ্রিস-নেজ পর্যন্ত নিয়ে যায়।
অত্যন্ত প্রতিকূল পরিস্থিতি এবং অদম্য ইচ্ছাশক্তির এক অনন্য সংমিশ্রণে আফরিন এই ম্যারাথন সাঁতার সম্পন্ন করেন। ডোভার থেকে ক্যাপ-গ্রিস-নেজ পর্যন্ত পৌঁছতে তাঁর সময় লেগেছিল ১৩ ঘণ্টা ১৩ মিনিট। তিনি মঙ্গলবার (ভারতীয় সময়) রাত ৯টা ৩১ মিনিটে তাঁর সাঁতার শেষ করেন, যা ছিল মেদিনীপুরসহ সারা রাজ্যের জন্য এক অত্যন্ত গর্বের মুহূর্ত। এই দীর্ঘ সাঁতারের সময় তাঁকে আটলান্টিক মহাসাগরের ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো হিমশীতল জলের তাপমাত্রা এবং তীব্র স্রোতের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছিল। এই ধরনের পরিবেশ সাঁতারুদের জন্য হাইপোথারমিয়া এবং অন্যান্য শারীরিক ঝুঁকির কারণ হতে পারে।
চ্যানেল সুইমিং অ্যাসোসিয়েশনের ওয়েবসাইটে আফরিনের এই কৃতিত্বকে বর্তমানে "Unratified" (অযাচিত) হিসেবে দেখানো হয়েছে। এই অবস্থাটি তাঁর সাঁতারের বৈধতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলে না, বরং এটি একটি আদর্শ প্রক্রিয়া যা একজন সাঁতারুকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য অতিক্রম করতে হয়। এর অর্থ হলো, সাঁতারের সময় উপস্থিত পর্যবেক্ষকের (observer) লগবুক, পাইলট বোটের নেভিগেশনাল ডেটা, এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় নথিগুলি এখন CSA কমিটি পর্যালোচনা করে দেখছে। এই যাচাইকরণ প্রক্রিয়া শেষে তাঁর সাঁতারটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে।
আফরিন জাবির এই সাফল্য একদিনে আসেনি। তাঁর যাত্রা শুরু হয়েছিল মেদিনীপুর শহরের দেওয়ান নগর এলাকার এক সাধারণ পরিবারে। ছোটবেলা থেকেই তিনি মেদিনীপুর সুইমিং ক্লাবে সাঁতারের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে তিনি এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য নিরলসভাবে প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ইংলিশ চ্যানেলের আগে তিনি ১৩ কিলোমিটার, ২১ কিলোমিটার এবং ২৪ কিলোমিটার দূরত্বের ম্যারাথন সাঁতারে সাফল্যের সাথে অংশ নিয়েছেন। তাঁর সবথেকে উল্লেখযোগ্য অর্জন ছিল ৮১ কিলোমিটার গঙ্গা ম্যারাথনে মেয়েদের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করা। এই সাফল্যগুলিই প্রমাণ করে যে ইংলিশ চ্যানেলের মতো একটি চ্যালেঞ্জিং ম্যারাথনের জন্য তিনি কতটা প্রস্তুত ছিলেন।
আফরিনের শিক্ষাজীবনও তাঁর সাঁতারের মতোই গতিময়। তিনি মেদিনীপুর কলেজে তাঁর স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করার পর উচ্চশিক্ষার জন্য আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় (AMU)-এর বি.পি.এড কোর্সে ভর্তি হন। আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ও তাঁকে তাঁদের প্রথম ইংলিশ চ্যানেল পার করা সাঁতারু হিসেবে গর্ব প্রকাশ করেছে।
আফরিনের সাফল্যকে পরিপূর্ণভাবে বুঝতে হলে তাঁকে ভারতের এবং বিশেষ করে বাংলার দীর্ঘ-দূরত্বের সাঁতারের ইতিহাসে স্থান দেওয়া প্রয়োজন। তিনি সেই গৌরবময় ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন যার সূচনা হয়েছিল কিংবদন্তী সাঁতারুদের হাত ধরে।
আফরিনের এই কীর্তির সঙ্গে প্রথমেই যার নাম উঠে আসে তিনি হলেন পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার কন্যা বুলা চৌধুরী। আফরিনের জন্মের আগেই, ১৯৮৯ সালে বুলা চৌধুরী ইংলিশ চ্যানেল পার করে প্রথম বাঙালি নারী হিসেবে এই গৌরব অর্জন করেছিলেন। তিনি তাঁর সাঁতারের ইতিহাসে কেবল একটি নয়, দুইবার ইংলিশ চ্যানেল পার (১৯৮৯ ও ১৯৯৯) করার পাশাপাশি প্রথম নারী হিসেবে পাঁচ মহাদেশের সাত সাগর জয় করেন। তাঁর এই অসামান্য কৃতিত্বের জন্য তিনি ১৯৯০ সালে অর্জুন পুরস্কার এবং ২০০৯ সালে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হন।
ইংলিশ চ্যানেলে ভারতের প্রথম সফল সাঁতারু ছিলেন মিহির সেন। ১৯৫৮ সালে তিনি ডোভার থেকে ক্যালে পর্যন্ত চ্যানেলটি পার হন এবং প্রথম এশীয় হিসেবে এই কীর্তি স্থাপন করেন। এই গৌরবময় যাত্রায় তাঁর সময় লেগেছিল ১৪ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট। তাঁর এই সাফল্যের জন্য তিনি ১৯৬৭ সালে পদ্মভূষণ এবং ১৯৫৯ সালে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হন।
এই প্রসঙ্গে, সাঁতারের ইতিহাসে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নাম হলো ব্রজেন দাস। ব্রজেন দাস (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, বর্তমানে বাংলাদেশ) ১৯৫৮ সালের আগস্ট মাসে ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রমকারী প্রথম দক্ষিণ এশীয় ছিলেন। মিহির সেন ছিলেন এর ঠিক পরেই, একই বছরের সেপ্টেম্বরে এই কৃতিত্ব অর্জনকারী প্রথম ভারতীয়।
আফরিনের এই সাফল্যের খবর মেদিনীপুরে এক অনাবিল আনন্দের ঢেউ তুলে এনেছে। তাঁর এই অসাধারণ কীর্তিতে গোটা শহর উচ্ছ্বসিত। জেলা প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা, যেমন জেলাশাসক খুরশিদ আলি কাদেরি, জেলা পুলিশ সুপার ধৃতিমান সরকার, স্থানীয় বিধায়ক সুজয় হাজরা এবং পৌরপ্রধান সৌমেন খান, সকলেই তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
আফরিনের বাবা শেখ পিয়ার আলী তাঁর মেয়ের সাফল্যে অত্যন্ত গর্বিত এবং উচ্ছ্বসিত। তিনি জানিয়েছেন, অনলাইনে মেয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে এবং বর্তমানে সে সম্পূর্ণ সুস্থ আছে।
আফরিন জাবির ইংলিশ চ্যানেল জয় এক নতুন যুগের সূচনা করেছে। তাঁর এই কৃতিত্ব অধ্যবসায়, কঠোর পরিশ্রম এবং দৃঢ় সংকল্পের এক অসামান্য উদাহরণ। বুলু চৌধুরী এবং মিহির সেনের মতো কিংবদন্তী সাঁতারুদের দেখানো পথ অনুসরণ করে আফরিন এখন নিজেই এক নতুন প্রজন্মের জন্য পথপ্রদর্শক।
আফরিনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও তাঁর পূর্বসূরীদের মতোই উচ্চাকাঙ্ক্ষী। তিনি ইংলিশ চ্যানেলের পর জিবারাল্টার এবং পক প্রণালীও অতিক্রম করতে চান বলে জানিয়েছেন। আফরিনের এই লক্ষ্য প্রমাণ করে যে তিনি কেবল একটি ব্যক্তিগত রেকর্ড গড়তে চাননি, বরং ভারতের ম্যারাথন সাঁতারের কিংবদন্তীদের কাতারে নিজের নাম লেখাতে আগ্রহী। তাঁর এই অর্জন মেদিনীপুর তথা সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ এবং ভারতের যুবসমাজকে অনুপ্রাণিত করবে।
0 মন্তব্যসমূহ
Thank you so much for your kindness and support. Your generosity means the world to me. 😊