দালাই লামার উত্তরসূরি নির্বাচন-তিব্বতি ঐতিহ্য বনাম চীনা কর্তৃত্ব
তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতা ১৪তম দালাই লামা তেনজিন গায়াতসো তাঁর ৯০তম জন্মদিনের প্রাক্কালে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা দিয়ে তিব্বতি বৌদ্ধ সমাজ ও আন্তর্জাতিক মহলে আলোড়ন তুলেছেন। তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তাঁর উত্তরসূরি নির্বাচন হবে ৬০০ বছরের পুরনো তিব্বতি বৌদ্ধ ঐতিহ্য অনুযায়ী, এবং এই প্রক্রিয়ায় চীনের কোনো হস্তক্ষেপ গ্রহণযোগ্য নয়।
এই ঘোষণার মাধ্যমে তিনি দীর্ঘদিনের অনিশ্চয়তার অবসান ঘটালেন এবং একইসঙ্গে চীনের সঙ্গে নতুন করে মতবিরোধের সূত্রপাত করলেন।
দালাই লামা জানিয়েছেন, তাঁর উত্তরসূরি নির্বাচন করবে গাদেন ফোদ্রাং ট্রাস্ট, যা তাঁর আধ্যাত্মিক দপ্তর হিসেবে কাজ করে। এই ট্রাস্ট তিব্বতি বৌদ্ধ ঐতিহ্যের নির্ভরযোগ্য ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করে পুনর্জন্ম শনাক্ত করার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবে। তিনি আরও বলেন, উত্তরসূরি চীনের বাইরে জন্মগ্রহণ করবেন এবং বেইজিং থেকে মনোনীত কাউকে তিব্বতি জনগণ যেন প্রত্যাখ্যান করে।
এই ঘোষণার পরপরই চীন কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছে, দালাই লামার উত্তরসূরি নির্বাচন করতে হলে তা চীনা সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে হতে হবে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং বলেন, “সোনার কলস প্রথা ও চীনা আইন অনুযায়ী নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে।” এই প্রথা অনুযায়ী, একটি সোনার পাত্র থেকে লটারির মাধ্যমে নাম বেছে নেওয়া হয়—যা ১৭৯২ সাল থেকে চালু আছে।
১৯৫৯ সালে চীনা বাহিনী তিব্বত দখল করার পর দালাই লামা ভারতে পালিয়ে আসেন এবং ধর্মশালায় নির্বাসিত সরকার গঠন করেন। সেই থেকে তিনি তিব্বতের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে উঠেছেন। চীন তাঁকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে বিবেচনা করে এবং তাঁর উপস্থিতি ভারত-চীন সম্পর্কে দীর্ঘদিন ধরে উত্তেজনার উৎস।
চীনের দাবি অনুযায়ী, তিব্বতের যেকোনো ধর্মীয় উত্তরসূরি নির্বাচন তাদের অনুমোদন ছাড়া বৈধ নয়। তবে দালাই লামার বক্তব্যে স্পষ্ট, তিনি এই দাবিকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই ইস্যুতে দালাই লামার পাশে দাঁড়িয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মুখপাত্র বলেন, “চীনের উচিত ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ বন্ধ করা।” একইসঙ্গে, নির্বাসিত তিব্বত সরকারের প্রেসিডেন্ট পেনপা শেরিং বলেন, “চীনের মনোনীত কোনো দালাই লামাকে তিব্বতিরা কখনোই মেনে নেবে না।”
তিনি আরও বলেন, “চীন সরকার তিব্বতি ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করছে, যা আমরা মেনে নেব না।”
তিব্বতি বৌদ্ধ বিশ্বাস অনুযায়ী, একজন দালাই লামা মৃত্যুর পর পুনর্জন্ম লাভ করেন এবং সেই শিশুকে বিভিন্ন আধ্যাত্মিক লক্ষণ ও পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত করা হয়। বর্তমান দালাই লামা মাত্র দুই বছর বয়সে তাঁর পূর্বসূরির পুনর্জন্ম হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিলেন।
এই ঐতিহ্যবাহী প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করেই আজকের দ্বন্দ্ব। চীন যেখানে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়, সেখানে দালাই লামা ও তাঁর অনুসারীরা ধর্মীয় স্বাধীনতা ও আত্মপরিচয়ের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন।
এই উত্তেজনার মধ্যেই একটি ইতিবাচক খবর এসেছে তিব্বতি নির্বাসিত সরকারের জন্য। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন তিব্বতের জন্য পূর্বে বন্ধ করে দেওয়া ৭ মিলিয়ন ডলারের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সহায়তা পুনরায় চালু করেছে। এই পদক্ষেপকে তিব্বতি নেতারা আন্তর্জাতিক সমর্থনের প্রতীক হিসেবে দেখছেন।
0 মন্তব্যসমূহ
Thank you so much for your kindness and support. Your generosity means the world to me. 😊