রবীন্দ্রনাথের সাথে বিভূতিভূষণের  প্রথম দেখা



 "To know how ro live is my trade."- সব বড় লেখকের জীবনই বেঁচে থাকার এক একটা ট্রেড সিক্রেট। বিভূতিভূষণেরও তাই। ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর কাঁচরাপাড়া হালিশহরের কাছে মুরাতিপুরে মামার বাড়িতে পৃথিবীর আলো দেখেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। বাবা মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়, মা মৃণালিনী দেবী। ভাইবোন মিলে পাঁচজন, বিভূতিভূষণই সবার বড়। 


বিভূতিভূষণের পৈত্রিক ব্যবসা ছিল কবিরাজি। কিন্তু পিতা মহানন্দ কাশী থেকে সংস্কৃত পড়ে শাস্ত্রী হয়ে আসলেও গ্রামে ফিরে কোন টোল খোলেননি, এমনকি আর্থিক উন্নতির দিকেও নজর দেননি কখনো। তাঁর সখ ছিলও কথকতা করা। নিজেই পালা লিখতেন, নিজেই গান করতেন। দূর দূরান্ত থেকে কথকতার জন্য ডাক পেতেন। কথকতার সুবাদে বাবার সাথে যেতেন ছোট্ট বিভূ। কখনও বাগবাজারের মদনমোহন তোলায় কখনও রংপুর আংড়াঘাটায়। তবে যেখানেই যেতেন সেখানেই কোনো না কোনো পাঠশালায় তিনি পড়াশুনা করতেন। 

ছেলেবেলা থেকেই বাবার দেখাদেখি বিভূতিভূষণের কথক হবার  সখ ছিল। "হাতে কঞ্চি নিয়ে ইছামতির নির্জন তীরে, ঝোপঝাড়কে লক্ষ্য করে তিনি দিনের পর দিন কথকতা করে যেতেন।" 

১৪ বছর বয়সে বিভূতিভূষণ ভর্তি হন বনগাঁ হাইস্কুলের পঞ্চম শ্রেণীতে। কিছুদিন পর এখানের হোস্টেলে থেকে তিনি পড়াশুনা শুরু করেন। কিন্তু বাবার মৃত্যু হওয়ার পর আর্থিক অবস্থার দরুন হোস্টেল ছাড়তে বাধ্য হন। বিদ্যালয়ে হেড মাস্টারমশাইয়ের চেষ্টায় বনগাঁর সরকারি ডাক্তারের বাড়িতে গৃহশিক্ষকতার সুযোগ পান। সেই বাড়িতে থেকেই ম্যাট্রিক পাশ (এখন মাধ্যমিক) করেন প্রথম বিভাগে। 


এখান থেকে কলকাতায় এসে ভর্তি হলেন রিপন কলেজে (বর্তমানে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ)। কলেজে পোড়া কালীন সময়ে একটি কবিতা এবং একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়, সম্ভবত এটিই তাঁর প্রথম লেখা- যদিও পরবর্তিতে সেই লেখার কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। 

কলেজে পড়াকালীন সময়েই রবীন্দ্রনাথকে তিনি প্রথম দেখেন। সেন্ট পল্‌স কলেজে রবীন্দ্রনাথ এলেন। কলকাতায় সদ্য আসা বিভূতিভূষণ রাস্তাঘাট ঠিক মতন চেনেন না। এক বন্ধু এসে বললেন "রবীন্দ্রনাথ আসবেন, দেখতে যাবে? শুনেই তো সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন। যার কবিতা ৮-৯ বছর বয়সে গুরুমশাইয়ের মুখে পাঠ করতে শুনেছেন, সেই রবীন্দ্রনাথকে দেখার বাসনা পূরণের জন্য ছুটলেন বিভূতিভূষণ। 

বিভূতিভূষণ নিজেই জানিয়েছেন সেদিনের অভিজ্ঞতার কথা- 

"বক্তৃতা শেষ হয়ে গেল। আমরা সবাই ঠেলাঠেলি করে তাঁর পায়ের ধূলা নিলাম, পায়ে তাঁর চকচকে বাদামী চামরার জুতা ছিল-সেকথা আজও ভুলিনি।

পরবর্তীকালে যখন তাঁর কাছে বসে কথাও বলেছি, তখনও তাঁর মুখের দিকে চেয়ে কখনই মনে করতে পারিনি, ইনিই আমাদের পাচজনের মতো মানুষ। আমার বাল্যমনের রঙে রাঙানো কল্পলোকের দেবতা হয়ে তিনি চিরদিন রইলেন আমার কাছে-তিনি সাধারণ লোক নন, তিনি অতি মানব, তিনি রবিঠাকুর।" 


তথ্যসূত্রঃ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়- সুনীলকুমার চট্টোপাধ্যায়