বাংলার ঐতিহ্য চড়ক উৎসব আজও অমলিন হলেও এবার এই উৎসব বন্ধ
শুভাশিস দাশ
গ্রাম এবং জন অর্থাৎ গ্রামীণ মানুষজনের এই উৎসব ই গাজন উৎসব l গাজন কথাটির বুৎপত্তি গর্জন থেকে l কারো মতে চড়ক সন্যাসীরা গর্জন করে বলে এই উৎসবের নাম হয় গাজন উত্সব l
সনাতন হিন্দু ধর্মের লিঙ্গ পুরাণে শিব ব্রত নিয়ে বলা আছে চৈত্র মাসে শিবের আরাধনা হেতু নাচ গানের উৎসবই চড়ক উৎসব l অবশ্য এই উৎসবের বর্ণনা কোথাও আবার অন্যরূপ দৃষ্ট হয় l
জনশ্রুতি থেকে জানা যায় ১৪৮৫ খৃ : সন্দরান্দ ঠাকুর নামের এক রাজা এই পুজো প্রথম শুরু করেন l কথিত আছে চৈত্র সংক্রান্তির দিনে শিব উপাসক বাণরাজা দ্বারকাধীশ কৃষ্ণের সঙ্গে যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত হয়ে দেবাদিদেব মহাদেবের প্রীতি উৎপাদন করে অমরত্ব লাভের আকাঙ্খায় নাচ গানের মাধ্যমে ও নিজের গায়ের রক্ত দ্বারা শিবকে তুষ্ট করে সিদ্ধ হন l তারই স্মৃতি বহন করে শৈব সম্প্রদায় এই দিনে গাজন উৎসবে মেতে উঠে l
এই চড়ক কোথাও নীল পূজা ,গম্ভীরাপূজা আবার শিবের গাজন নামে পরিচিত l
চৈত্র মাস পড়তেই শুরু হয়ে যায় এই চড়কের আয়োজন l আজও গ্রাম গঞ্জে দলে দলে মানুষ সারা মাস শিবের পাটা নিয়ে সিঁদুর পরিয়ে পথে পথে মাগনে বেরোয় l সঙ্গে থাকে ঢাকের বাদ্যি l শিব পার্বতীর সঙ সেজে তারা মানুষ জনকে নৃত্য প্রদর্শণও করে থাকে l
চড়ক পুজোয় খুব নিয়ম নিষ্ঠা লাগে l সংক্রান্তির আগের দিন চড়ক গাছ কে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করা হয় l এই পুজোর অঙ্গ হিসেবে কুমিরের পুজো ,কাঁটা-ছুরির উপর লাফানো ,বাণফোঁড়া ,অগ্নি নৃত্য ,চড়ক গাছে দোলা এবং দা চালান বা হাজরা পুজো l
এই লৌকিক আচার অনুষ্ঠান মূলত ভূত প্রেত ও পুনর্জন্মবাদের উপর বিশ্বাস করে
আর তাই তো মরার খুলি সহ শব দেহের করোটি নিয়ে চলে তাণ্ডব l
চড়ক কে কেন্দ্র করে সন্ন্যাসীরা নিজেদের শরীর কে লোহার হুড়কা ,বড়শি ইত্যাদি দিয়ে হাতে পিঠে এবং জিহ্বায় ফুরায় l
চৈত্র সংক্রান্তির ক দিন আগে থেকে চলে নিয়ম নিষ্ঠার পালা l অত্যন্ত সংযম করে এই পুজোয় অংশ নেন চড়ক সন্ন্যাসীরা l
সংক্রান্তির আগের দিন রাতে হাজরা পুজো হয় এই পুজোয় মহাদেবের উদ্দ্যেশে খিচুড়ি ও শোল মাছের ভোগ নিবেদন করা হয় এবং পরে তা প্রসাদ হিসাবে ভক্তদের মধ্যে বিতরণ করা হয় l এই হাজরার মাঝ রাত থেকে কোন কোন সন্ন্যাসীর ভর ওঠে এবং দা অথবা ধারালো অস্ত্র পাগলের মতো ঘুরাতে থাকে যাকে ওদের তান্ত্রিক ভাষায় দা চালান বলে l অনেক সন্ন্যাসী দেবতাকে সন্তুষ্ট করতে নিজের শরীরের উপর অত্যাচার করতে থাকে l
উত্তর বঙ্গে এই চড়ক বা গাজন উৎসব মালদহ ,জলপাইগুড়ি এবং কোচবিহারের বিভিণ্ন অঞ্চলে হয়ে থাকে l মালদহ -এ গাজ্নের নাম গম্ভীরা ,জলপাইগুড়িতে গোমীরা এবং কোচবিহারের চড়ক বা অঞ্চল ভেদে গাজন বলে l অবিভক্ত উত্তরে রাজশাহী এবং রংপুরে চড়ক বিখ্যাত l
বঙ্গ সংস্কৃতির এই গাজন উৎসবের সাথে ভুটানের চোড়গ ,শ্রীলংকার টুককুম ,মহারাষ্ট্রের বগাড় উৎসব এর সাদৃশ্য লক্ষ্য কড়া যায় l
এই গাজন কে কেন্দ্র করে বসে মেলা l
উত্তরের জনজীবনে এই চড়ক মেলা একটি বড় জায়গা করে আছে l
চড়ক পুজোর সন্ধ্যা বেলায় মেলার মাঠেই পোঁতা হয় চড়ক গাছ আর সেই গাছে গুটি কতেক সন্নাসী পিঠে ,জিহ্বায় হাতের তালুতে বড়শি ফুরিয়ে চড়ক গাছে ঘোরে l
মেলার প্রধান আকর্ষণই থাকে এই চড়ক গাছের খেলা l
প্রগতির এই যুগে এই চড়ক বা গাজন উত্সবের জৌলুস এতটুকুও কমেনি বিশেষ করে উত্তরের জন জীবনে l কিন্তু বিশ্ব জুড়ে করোনা ভাইরাসের
দাপটে জনজীবন বিপর্যস্ত । আমরাও আক্রান্ত । এই সংকট কালে এই চড়ক উত্সব এবার বন্ধ হয়ে গেছে সর্বত্র ।
Social Plugin