সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতায় প্রেম
সম্রাট দাস

যে বাঙালি প্রেমে পড়লে কবি হয়ে ওঠে কিংবা কবিতা লিখলে প্রেম লেখে- সেই বাঙালি তথা বাংলা কবিতার জগতে সুভাষ মুখোপাধ্যায় অন্যধাতুতে গড়া বলেই জানা যায়। রাজনীতি তার কবিতার বিষয়-আশয়। তার কবিতা ‘শ্লোগানধর্মী’। তাহলে বাঙালি এই কবি প্রেম লিখলেন না? আঁকলেননা কোন নারীর ছবি? পদাতিকপ্রকাশের বছরেই কবি, সমালোচক ও সম্পাদক বুদ্ধদেব বসু এই গ্রন্থের কবিতা নিয়ে লিখলেন- সুভাষ মুখোপাধ্যায় দুটি কারণে উল্লেখযোগ্য: প্রথমত, তিনি বোধ হয় প্রথম বাঙালি কবি যিনি প্রেমের কবিতা লিখে কাব্যজীবন আরম্ভ করলেন না। এমনকি, প্রকৃতি বিষয়ক কবিতাও তিনি লিখলেন না; কোনো অস্পষ্ট, মধুর সৌরভ তার রচনায় নেই, যা সমর সেনেরও প্রথম কবিতাগুলিতে লক্ষণীয় ছিলো। দ্বিতীয়ত, কলাকৌশলে তাঁর দখল এতই অসামান্য যে কাব্য রচনায় তাঁর চেয়ে ঢের বেশি অভিজ্ঞ ব্যক্তিদেরও এই ক্ষুদ্র বইখানায় শিক্ষণীয় বস্তু আছে বলে মনে করি। সমালোচকের এই বক্তব্য সম্পূর্ণ মেনে নিতে পারছি না। তাঁর কাব্যগ্রন্থ পাঠে প্রেমিক সুভাষের ছবিটি স্পষ্ট ভাবেই ফুটে ওঠে। 
সুভাষ মুখোপাধ্যায় এর জন্ম ১৯১৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি বুধবার, নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে। পৈত্রিক নিবাস ছিল কুষ্টিয়া জেলার দর্শনার লোকনাথপুরে। শৈশব কেটেছে রাজশাহী জেলার নওগাঁয়। তিনি কাব্যজীবন শুরু করেন ১৯৪০ সালে। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ পদাতিক' প্রকাশিত হয়। ৪০ দশকের আরেক শক্তিশালী কবি সমর সেন। সমর সেনের কবিতায় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অসহায়ত্বের চিহ্ন ছিল। ফুটে উঠেছিল অর্থনৈতিক হতাশার ছবি। এই ব্যর্থতাকে শক্তিতে পরিণত করে কাব্য রচনা করলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। তাঁর প্রতিটি কবিতায় প্রতিবাদের ভাষা, মুক্তির গান। মধ্যবিত্ত শ্রেণির দোলাচলবৃত্তির গোলকধাঁধা থেকে উত্তরণের আশায় উজ্জীবিত। প্রথম গ্রন্থই সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নেয়। এরপর ক্রমে প্রকাশিত হয় আরো ৫টি কাব্যগ্রন্থ। ১৯৪০ এ পদাতিক, ১৯৪৮- অগ্নিকোণ, ১৯৫০-চিরকূট, ১৯৫৭-ফুল ফুটুক, ১৯৬২-যত দূরে যাই, ১৯৬৬-কাল মধু মাস, ১৯৯১-ধর্মের কল। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন পত্রিকার সাথে যুক্ত ছিলেন। প্রথমে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সার্বক্ষণিক কর্মী ছিলেন। পার্টির মুখপত্র দৈনিক জনযুদ্ধ পত্রিকার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। কিন্তু ১৯৪৮ এ পার্টি কর্তৃক নিষিদ্ধ হন এবং আড়াই বছর কারাবাসে থাকেন। কিন্তু আজীবনই তিনি এ মতবাদকে ধারণ করেছেন। তার কবিতায় তাই সৈনিকের শ্লোগানের সুর। মাঝে ১৯৪৬ এ দৈনিক স্বাধীনতায় কাজ করেন। পরিচয় পত্রিকার সাথে যুক্ত হন ১৯৫১ সালে। 
‘প্রেম আবেগনির্ভর’- কথাটির বিতর্কে না গিয়েও বলতে হয় বাস্তবের রুক্ষ্মমাটিতেই প্রেমের আবেগ জন্ম নেয়। প্রেমের অঙ্কুরোদ্গমের সময় সমস্ত রুক্ষ্মতাই তখন ম্লান হয়ে গেলেও রুক্ষ্মতাই তার চরম বিপর্যয় ঘটায়। কিন্তু তবুও প্রেম থেকে যায় অমলিন- স্বর্গীয় সুবাসে সুবাসিত থাকে। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতায় প্রেম এসেছে এই বাস্তব রুক্ষ্মতাকে স্বীকার করেই। কবি বাস্তবের নির্মমতার মাঝে প্রেমের বহু বিচিত্র রূপকে তুলে এনেছেন নিজের মুন্‌শিয়ানায়। 
পদাতিক কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতায় কবি লিখলেন-
“তিল তিল মরনেও জীবন অসংখ্য
জীবনকে চায় ভালোবাসতে।”
জীবনকে ভালোবাসবার কথা বলেই কবি পরের স্তবকে শোনালেন-
“প্রণয়ের জৌতুক দাও প্রতিবন্ধে,
মারণের পণ নখদন্তে
বন্ধন ঘুচে যাবে জাগাবার ছন্দে,
উজ্জ্বল দিন দিক্‌ অন্তে।”
কবি ভালবাসাকে প্রতিবন্ধে, নখদন্তে, জাগবার ছন্দে উজ্জ্বলদিন আনবার জন্য ব্যবহার করেছেন।
‘সকলের গান’ কবিতায় কবি লিখলেন-
‘কমরেড, আজ নবযুগ আনবেন না?
কুয়াশাকঠিন বাসর যে সম্মুখে।”
‘বাসর’ শব্দটাকে নজর দিলেই বোঝা যায় প্রেমের প্রতি কবির গভীর আকুলতাটিকে। মনের গোপন বন্দরে ভালোবাসার যে রক্তরাগ প্রবাহিত হতো কবির তা এই ‘বাসর’ শব্দের প্রয়োগেই স্পষ্ট বলে মনে হয়।
বিষয় প্রসঙ্গে ‘রোমান্টিক’ শিরোনামের কবিতাটিকে আলোচনায় আনতেই হয়-
‘নিজেরই একদা কল্পিত সব স্বপ্ন
সেলাইয়ের প্রতি সুতোয় লুকোয় লজ্জা।”
চরণদুটি পাঠকরা মাত্রই কোন নারীর চিত্র চোখের সামনে ভেসে আসেনা কি! নিরিবিলিতে বসে যে সেলাই করতে করতে কখন চলে যায় প্রেমিকের কাছে- প্রিয় মানুষটির কাছে! ছুঁচের আঘাতে স্বপ্ন ভেঙে যায়, লজ্জা নেমে আসে মুখে। মাত্র দুটো চরণে এমন প্রেমময় চিত্রকল্প অবাক করে দেয়। এই কবিতাতেই কবি আরও লিখলেন-
“রাত্রি কিন্তু রাত্রিরই পুনরুক্তি
চাঁদের পাড়ায় মেঘের দুরভিসন্ধি
হৃদয়-জোয়ারে ভেঙে যায় সংকল্প
ম্লান হয়ে যায় সব হারাদের বস্তি।”
চাঁদনি রাতে মেঘের ছুটে বেড়ান হৃদয়ে জোয়ার আনে যে কোন প্রেমিকের। সেই প্রেমানুভূতি অন্য সব অনুভূতিকেই ম্লান করে দিতে পারে। প্রেমের এই শক্তিকে কবি যে কতটা গভীর ভাবে জানতেন তা তার এই চরণগুলিতেই বোঝা যায়।

‘বঁধু’ কবিতাতে লিখলেন-
‘কলসি কাঁখে চলছি মৃদু চালে
হঠাৎ গ্রাম হৃদয়ে দিল হানা
পড়ল মনে, খাসা জীবন সেথা।”
প্রেমময় জীবনকে কবি যে ‘খাসা জীবন’ বলেছেন তা কবিতাটিতে স্পষ্ট। এই কবিতাতেই আরও পাই-
“ ছাদের পারে হেথাও চাঁদ ওঠে
দ্বারের ফাঁকে দেখতে পাই যেন
আসছে লাঠি উচিয়ে পেশোয়ারি
ব্যাকুল খিল সজোরে দিই মেলে।”
প্রিয়তমাকে চাঁদের সাথে তুলনা -এতো প্রেমের স্বভাবজাত। কবির প্রেমিক সত্ত্বা কতটা জাগ্রত তা পরিষ্কার বোঝা যায়। এখানেই শেষ নয় ‘লাঠি উচিয়ে পেশোয়ারি’র আগমনে সরে যেতে বাধ্য প্রেমিকা কীভাবে অনুশোচনায় দগ্ধ হয় তা পরবর্তী স্তবকে আরও স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে-
‘ইহার মাঝে কখন প্রিয়তম
উধাও; লোকলোচন উঁকি মারে-
সবার মাঝে একলা ফিরি আমি
লেকের কোলে মরণ যেন ভালো।”
শুধু প্রেমিকের মনের কথাই নয়, কবি এক প্রেমিকার অন্তর্জগতের কথা তুলে এনেছেন এই কবিতায়। প্রিয়তমাকে না দেখতে পেয়ে সবার মাঝে থেকেও কীভাবে ‘একলা’ হয়ে পড়ে প্রেমিকা সেই একাকীত্বের যন্ত্রণার থেকে ‘লেকের কোলে মরণ’ ভালো বলে মনে হয়।  

‘মেজাজ’ কবিতায়- ‘দাম্পত্য জীবনের রূপচিত্র উঠে এসেছে এই কবিতায়- বিবাহিত জীবন কতটা দুর্বিষহ হয়ে ওঠে পুরুষের জীবন তা তুলে ধরেছেন-
‘থলির ভেতর হাত ঢেকে
শাশুড়ি বিড়বিড় করে মালা জপছেন,
বউ
গটগট গটগট করে হেঁটে গেল।
*******
তারপর সারা বাড়িটাকে আঁচড়ে আঁচড়ে
কলতলায়
ঝমর ঝম খনর খন ক্যাচ ঘ্যাঁষ ঘিঁষ ক্যাচর ক্যাঁচর
শব্দ উঠল।’
সংসারে যত অশান্তিই থাক না কেন, স্বামী-স্ত্রীর মধুর সম্পর্কটিও কবির নজর এড়ায়নি-
“বউ বলছে; ‘একটা সুখবর আছে।’
পরের কথাগুলো এত আস্তে যে শোনা গেল না।
খানিক পড়ে চকাস চকাস শব্দ,
মা হয়ে আর দাঁড়াতে লজ্জা করছিল।
কিন্তু তদন্তটা শেষ হওয়া দরকার-
বৌয়ের গলা, মা কান খাড়া করলেন।
বলছে; ‘দেখো, ঠিক আমার মতো কালো হবে।’
এরপর একটা ঠাস করে শব্দ হওয়া উচিত।
ওমা, বউমা বেশ ডগমগ হয়ে বলছে;
কী নাম দেবো, জান?
আফ্রিকা।
কালো মানুষেরা কী কান্ডই না করছে সেখানে।’
প্রেমের এই অনুভূতি এতো নিখুঁত ভাবে তুলে ধরবার পরও বলবো, সুভাষ প্রেম লেখেনই!!

‘তোমাকে বলিনি’ কবিতায় প্রেমের  আর এক মিষ্টি ছবি কবি তুলে ধরেছেন-
“ ঘরে বৃষ্টির ছাঁট এলেও
জানলাগুলো বন্ধ করি নি-
আলো- নেভানো অন্ধকারে
থেকে থেকে ঝিলিক দেওয়া বিদ্যুতে
আমি দেখতে পাচ্ছিলাম তোমার মুখ।”
‘জলছবি’তে কবি এক লক্ষ্মীর রূপ আঁকলেন হৃদয়ের রঙ দিয়ে-
‘একটি বার দৌড়ে এসো
ও নদী, ও স্মৃতি
ঘরের এই দেয়াল ধরে
দাড়াও না, লক্ষ্মীটি।’
একটা বিষয় লক্ষ্যনীয়, সুভাষের কবিতায় বিবাহিত মানব-মানবীর মনের দোলাচালতাই বেশী স্থান পেয়েছে। স্বামীস্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে ভালোবাসার অবস্থানটিকে গুরুত্ব দিয়েছেন বেশীমাত্রায়।

 সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাছে-
'প্রেমে জাগে বিচ্ছেদের ভয়,
পদে পদে ভুলভ্রান্তি
অথচ জীবন তার চেয়ে বড়ো
ঢের ঢের বড়ো.'
যে সমাজে কখনও সত্যিকারের মুক্তি আসে না, যেখানে কবি নিজেকে সংগ্রামী সৈনিকের পোশাকে সজ্জিত করেছেন, যাঁর হাতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে উদ্যত সঙ্গিন, যাঁর মুখে শ্রেনিহীন সমাজের শ্লোগান, তাঁর কাছে ব্যক্তিগত প্রেম, নিছক যৌনপ্রেম গৌণ।
প্রেমের জন্য না বেঁচে, বাঁচার জন্য যতটুকু প্রেম প্রয়োজন, তাঁর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছেন। তবে সুভাষ প্রেম লেখেননি একথা কোনমতেই মেনে নেওয়া জায় না। প্রেমের এক স্নিগ্ধ মধুর ছবিই বারবার উঠে এসেছে তাঁর কবিতায়।
আর তাঁর নারীরা প্রেমের জন্য জীবন উৎসর্গ করেনি বরং কঠিন সমাজ থেকে বাঁচার চেষ্টায় সর্বদা তৎপর থেকেও প্রেমের সুধা পান করেছেন নতুন প্রানস্পন্দনে উদ্দিপ্ত হবার জন্য। জীবনের জন্য যে প্রেম বা ভালোবাসার প্রয়োজন তা কখনোই কবি অস্বীকার করেননি। সাধারন নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত সমাজ জীবনের প্রেমের বাস্তব রূপটিকেই কোনোরকম পরিবর্তন না করেই যেন সরাসরি তুলে এনেছেন তাঁর কবিতায়। ‘পদাতিক কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়’ গ্রন্থে অধ্যাপক অর্ধেন্দু সরকার যথার্থই লিখেছেন-
“ সুভাষ ধরাবাঁধা রমান্টিকতায় বিশ্বাসী নন। সুভাষের প্রেমকে তাই বাঁধা গতির পর্যায়ে ফেলা যায় না। আসলে সুভাষের প্রেম ভাবনায় আবেগ যতখানি আছে, যুক্তিও আছে সেই পরিমাণ। ফলে সুভাষ কর্তব্য-কর্মের মাঝে দাঁড়িয়েই ভালোবাসোতে চান; ভালোবাসা পেতে চান। তাঁর কাছে প্রেম কোনো স্বপ্ন বিলাসিতার প্রাঙ্গন নয়; বরং তা জীবন পথে এগিয়ে চলার বাস্তব প্রেরণা। শুধু প্রেরণা নয়; সুভাষের কাছে প্রেম জীবনে এষনা ও প্রেষণা।” (পৃষ্ঠা-৬২)



সহায়ক গ্রন্থঃ
১) সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতাঃ দে’জ পাবলিশিং
২) ‘পদাতিক কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ঃ অধ্যাপক অর্ধেন্দু সরকার, পাণ্ডুলিপি