Kazi Nazrul Islam: শ্যামা ও ইসলামিক সঙ্গীত : সম্প্রীতির মেলবন্ধনে নজরুল

শ্যামা ও ইসলামিক সঙ্গীত : সম্প্রীতির মেলবন্ধনে নজরুল


Kazi Nazrul Islam

 




ড. সঞ্জীবন মণ্ডল


বাংলার কবি, বাঙালির প্রাণের কবি, চুরুলিয়া গ্রামের কবি দুখু মিঞা।যিনি পাঠক সমাজে বিদ্রোহী কবি হিসেবেই অধিক পরিচিত এবং কবি হয়েও নিজে সৈনিকের বেশে যুদ্ধ করেছেন।যাঁর হাতে ছিল অস্ত্র, বুক পকেটে ছিল কবিতার খাতা।যাঁর কবিতায় উদ্বুদ্ধ হয়েই হাজার হাজার সৈনিক যুদ্ধক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পরতে উৎসাহি হতেন, বিপ্লবের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়েই দেশমাতৃকার মুক্তিপণে আত্মাহুতি দিয়েছেন কতশত বিপ্লবী। দেশভাগের পরে সেই নজরুলকে নিয়ে অন্নদাশংকর রায় লিখেছিলেন- ‘ভুল হয়ে গেছে বিলকুল/আর সবকিছু ভাগ হয়ে গেছে/ ভাগ হয়নিকো নজরুল’।


বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪শে মে কবির জন্ম। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে যিনি করাচিতে কাটিয়েছেন যৌবনের একটা সময়। যাঁর লেখনীর তীক্ষ্ণতা ফুটে উঠেছে কলকাতায় বসে। যাঁর কবর রয়েছে বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে। যিনি যৌবনে পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গকে কখনোই আলাদা চোখে দেখেননি।এমনকি বিয়েও করেছিলেন পূর্ববঙ্গের সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারে।


যুগের পরিবর্তনে উপমহাদেশের রূপ পালটে গেছে অনেকটাই।সিলেট- ঢাকা, করাচি-লাহোর যেতে হলে পাসপোর্ট অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু নজরুলের লেখা সাহিত্য সঙ্গীত পাসপোর্টকে উপেক্ষা করেই বর্তমানেও বাঙালির হৃদয় জুড়ে বিরাজমান।এতকিছু সত্যেও মাঝে মাঝে কবির লেখনী নিয়ে কমবেশী প্রশ্ন ওঠে। যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে সত্তরের দশকে অন্নদাশংকর রায় আবার কলম ধরেছেন- ‘হায় কী বেদন!/হায় কী রোদন!/ সন্তান অভাগার/পিতার কবরে একমুঠো মাটি/দেওয়া হল না কো আর/কেউ জানলনা ইতিহাসে ফের/ভুল হয়ে গেছে বিলকুল/এতকাল পরে ধর্মের নামে/ ভাগ হয়ে গেল নজরুল’।


নজরুলকে প্রথম ভাগ করার চেষ্টা করেছিল পশ্চিমপাকিস্তান- সে বিষয়ে কোন সন্দেহ থাকার কথা নয়। তারাই প্রথম ঘোষণা করেছিলেন- প্রয়োজনে বাতিল করতে হবে ‘নজরুল কাব্যের অবাঞ্ছিত অংশ’। এই ‘অবাঞ্ছিত অংশ’ হিসেবে পশ্চিমপাকিস্তানিরা দেখেছিলেন কবির কাব্য ও সঙ্গীতে হিন্দু দেবদেবীর প্রকাশ্য ছায়া। কিন্তু তারা খেয়াল করেনি- কবি বিয়ে করেছিলেন প্রমীলা সেনগুপ্তকে; যিনি একজন হিন্দু পরিবারের মেয়ে। এমনকি কবি তাঁর পুত্রদের নামের ক্ষেত্রেও হিন্দু মুসলিম দুটি নামের সমীকরণে কৃষ্ণ মুহম্মদ, কাজী সব্যসাচী, কাজী বুলবুল, কাজী অনিরুদ্ধ রেখেছিলেন।


কবির বাল্যকাল নিয়ে আমরা সবাই কমবেশি জানি। তিনি সগর্বে ঘোষণা করেছিলেন-‘হে দারিদ্র তুমি মোরে করেছো মহান’। তাই সেই বিষবস্তুতে আমরা প্রবেশ করছিনা। বাল্যকালে মক্তবে পড়শুনা এবং কিছুকাল শিক্ষকতা করেছিলেন বলে আরবী ফারসী উর্দু শব্দ সম্বন্ধে একটা সাধারণ পরিচয় তাঁর গড়ে উঠে।শুধু তাই নয়- একই সময়ে তিনি মাজার শরীফের খিদমাদগিরি, মসজিদের ইমামি এবং গ্রামে মোল্লাগিরিও করেছিলেন।পরবর্তিকালে শিক্ষালাভ করেন বিভিন্ন স্কুলে।


অল্প বয়সেই লেটো গানের দলে, কবিগানের দলে কাজের সূত্রেও তিনি বিভিন্ন ভাষা ও শব্দকে আয়ত্ত করেছিলেন। এমনকি কবির পূর্বপুরুষ পাটনা থেকে আসানসোলে এসেছিলেন। সেই সূত্রেও পারিবারিক মাধ্যমে কবির মধ্যে কমবেশী উর্দু শব্দের ব্যবহার ছিল।বাল্যকালে গ্রামে তিনি ক্ষ্যাপা ও নজর আলী নামেও সম্বোধন হতেন। যেখানেও সম্প্রীতির ছাপ বর্তমান।বাল্যকাল থেকেই কবির মধ্যে হিন্দু ও মুসলিম ব্যক্তিদের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। যেমন তিনি হাফিজ নুরুন্নবীর কাছে ফার্সী ভাষা পাঠ নিলেও সতীশ চন্দ্র কাঞ্জীলালের কাছে ভারতীয় রাগ সঙ্গীত আয়ত্ত করেছিলন।


বন্ধু শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের মাধ্যমেই তিনি মুজফর আহমেদের সাথে ঘনিষ্ঠতা লাভ করেন। প্রথম জীবনে লেখালেখির ক্ষেত্রে ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকাই তাঁকে পরিচিতি দিতে থাকে। মাসিক ‘সওগাত’ পত্রিকাতেই তাঁর আত্মজীবনী প্রকাশ হয়েছিল। মোহম্মদ শহীদুল্লাহ’র মাধ্যমেই কবির সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘনিষ্ঠতা ও প্রথম সাক্ষাৎ হয়। মণিভুষণ মুখোপাধায়ের সাথেই তিনি ‘লাঙল’ পত্রিকা পরিচালনা করেন।আর্থিক সংকটে ও ভাগ্যের পরিহাসে তিনি কলকাতায় নলিনীকান্ত সরকারের বাড়িতেও আশ্রয় নিয়েছিলেন।এগেল কবির ব্যক্তিগত জীবনে হিন্দু মুসলিম সংস্পর্শের সম্পর্ক।



যে লোকটি প্রথম জীবনেই মোজাফর আহম্মদের মতো কমিউনিস্ট তাত্ত্বিক নেতার সাথে দীর্ঘদিন ছিলেন এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে নিজেকে ধন্য করেছেন; তিনি কেন একটা সময় লিখলেন- ‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই/যেন গোরে থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই’।এপ্রশ্নের উত্তর দেওয়া যেমন কঠিন তেমনি এর দীর্ঘ ইতিহাস লক্ষ্য করা যায়। যে ইতিহাসের একটা মূল উদ্দেশ্য ছিল ইসলামিক সঙ্গীতের মাধ্যমে জাতিকে উদ্বুদ্ধ করা, জাতির মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ ও দেশপ্রেম গড়ে তোলা, সেই সাথে কবির ব্যক্তিগত আর্থিক সংকটের পরিত্রাণ থেকে রেহাই পাওয়া।এই গানের প্রসঙ্গেই কবির মধ্যে অনেকে সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ খুঁজে পান।


এর সঠিক উত্তর জানার জন্য আমাদের অসাম্প্রদায়িক নজরুলের দিকে তাঁকাতে হবে। যে নজরুল একই সাথে আরাধনা করেছেন শ্যামাসঙ্গীতের আবার একই সাথে লিখেছেন ইসলামিক সঙ্গীত। তিনি প্রায় চার হাজার গান রচনা করেছেন- যেগুলি ‘নজরুল সঙ্গীত’ নামে পরিচিত। এই গানগুলির অধিকাংশেরই তিনি নিজেই সুর দিয়েছিলেন।


নজরুল সঙ্গীতের মধ্যে রয়েছে প্রায় তিনশত এর মতো ইসলাম বিষয়ক সঙ্গীত এবং অসংখ্য শ্যামা সঙ্গীত। রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত শ্যামা সঙ্গীত রচনা করেই বিখ্যাত হলেও নজরুলের শ্যামাসঙ্গীতের মূলচেতনা ছিল আত্মসচেতনতা এবং আমিত্ববিসর্জনের প্রবণতা, সেই সাথে দেশপ্রেম, অহিংসাপরায়ন,মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধে যুব সম্প্রদায়কে উদ্বুদ্ধ করা।এই গানগুলি ব্যঞ্জনার মাধ্যমে এক একটি বিপ্লবের জয়গাঁথা হিসেবেও তৎকালীন সময়ে পরিবেশন হতো । তাঁর ‘রাঙা জবা’ কাব্যগ্রন্থটি পড়লেই কবির শাক্তপ্রেম সহজেই বোঝা যায়। নামে শ্যামা সঙ্গীত হলেও এই গান সর্বধর্মের প্রতীকস্বরূপ, যার মূল ভিত্তি সমাজতন্ত্রের কথাও বলে।


শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে শ্যামাসঙ্গীতের মাধ্যমে তিনি তুলে ধরেছেন- ‘সিন্ধুতে মা’র বিন্দুখানিক,/ ঠিকরে পরে রূপের মাণিক,/বিশ্বে মায়ের রূপ ধরেনা,/ মা আমার তাই দিগবসন’। হিন্দুসমাজে কালী বা শ্যামা শক্তির উপাসক হিসেবেই পূজিত ও গ্রাহ্য। নজরুল এই শ্যামার মধ্যে আর একটি নবরূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন,সেটি হল দেশমাতৃকার রক্ষক হিসেবে দেবীর আরাধনা।তাই তিনি তাঁর একাধিক গানেও কখনো মা, মাতা ইত্যাদি ব্যবহার করেছেন।


স্বদেশীয়ানায় উজ্জীবিত করতেই তিনি সেই উপমাগুলি ব্যবহার করেছেন বলা যায়। আবার চিত্তের ভাবকে বর্ধিত করতেও তিনি শ্যামাসঙ্গীতের আশ্রয় নিয়েছেন। যেমন- ‘ভক্তি আমার ধুপের মত, উর্দ্ধে উঠে অবিরত/শিবলোকের দেবদেউলে,/মা’র শ্রীচরণ পরশিতে’ গানটি। স্বদেশীয়ানা এবং বিলাতি দ্রব্য বর্জনের আন্দোলনে তিনি আশ্রয় নিয়েছেন-‘কেন আমায় দেখাস মা ভয়,/ খড়্গ হাতে মুণ্ড নিয়ে,/আমি কি তোর সেই সন্তান,/ভোলাবি মা ভয় দেখিয়ে’? তৎকালীন একাধিক হিন্দু সমাজপতি তাঁকে ‘যবন’ বলে যেমন সম্বোধন করেছেন তেমনি মুসলিম সমাজপতিরাও তাঁকে ‘কাফের’ বলে বিষোদ্গার করেছেন। কিন্তু নজরুল দমে যাননি। কলম চালিয়েছেন-‘ শ্যামা মায়ের কোলে চড়ে জপি আমি শ্যামের নাম/ মা হলেন মোর মন্ত্রগুরু, ঠাকুর হলেন রাধা শ্যাম’।‘আনন্দময়ীর আগমন’ কবিতায় কবি শ্যামাকে আরাধনা করেছেন নারীসমাজের উদ্ধারকর্তৃ হিসেবে- ‘আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল?/স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারি শক্তি চাঁড়াল।/দেব শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবকদের দিচ্ছে ফাঁসী, ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী’? এই কবিতা তথা গানটির জন্য কবির কারাদণ্ড হয়েছিল। এই পর্যায়ের অন্য একটি সঙ্গীতে তিনি লিখেছেন-‘ অন্ন দিয়ে ত্রি-জগতে/অন্নদা মোর বেড়ায় পথে,/ ভিক্ষু শিবের অনুরাগে/ ভিক্ষা মাগে রাজদুলালী’।


দেশমাতৃকা বন্ধনে নিজেকে সঁপে দিতে কবিও জবার সঙ্গে তুলনা করে ব্যক্ত করেছেন-‘ বলরে জবা বল/ কোন সাধনায় পেলি শ্যামা মায়ের চরণতল/মায়া-তরুর বাঁধন টুটে/মায়ের পায়ে পড়লি লুটে/মুক্তি পেলি, উঠলি ফুটে আনন্দ বিহ্বল’। কারা শৃঙ্খল ভাঙতে চেয়েছেন কবি শ্যামাসংগীতের মাধ্যমে। তাই ঘোষণা করেছেন-‘দশ পায়ে দশ দিকে আঘাত হানো,/দশ হাতে দশবিধ আয়ুধ আনো,/দশ মুখ-কমলে অভয়বাণী/শোনাও আর্তজনে বিপদ-বারিণী’। শ্যামাকে তিনি যেমন মাতৃরূপে কল্পনা করেছেন তেমনি কন্যা রূপে কবির স্নেহ ভালোবাসা ব্যক্ত হয়েছে দেবীর প্রতি-‘(আমার) কালো মেয়ে পালিয়ে বেড়ায় কে দেবে তা’য় ধরে/ (তারে) যেই ধরেছি মনে করি অমনি সে যায় স’রে’। অপর একটি সঙ্গীতে লিখেছেন- ‘আমার কালো মেয়ে রাগ করেছে/কে দিয়েছে গালি/রাগ ক’রে সে সারা গায়ে/মেখেছে তাই কালি’।বহুত্ববাদের মধ্যে একাত্ববাদের কল্পনায় কবি শ্যামার রূপ অঙ্কন করেছেন-‘ভালোবেসে আমার শ্যামা মাকে/যার যাহা সাধ সেই নামে সে ডাকে, সেই নামে মা দেয় যে সাড়া/ কেউ শ্যামা কয় কেহ শ্যাম/একসাগরে মিশে গিয়ে সকল নামের নদী/ সেই হরিহর কৃষ্ণ ও রাম, দেখিস তাঁকে যদি’।


অন্য একটি সঙ্গীতে উমা পার্বতি ও কালীকে একসূত্রে গ্রথিত করেছেন কবি- ‘আয় বিজয়া আয়রে জয়া/উমার লীলা যা রে দেখে/সেজেছে সে মহাকালি/চোখের কাজল মুখে মেখে’। এইভাবে আরও অজস্র গানের ভিন্ন ভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা যায়। যে যাই বলুক তিনি ছিলেন মানব পূজারী। তাই ঘোষণা করেছিলেন- ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান’। হিন্দু মুসলমানের বিভেদনীতির বিরুদ্ধে তিনি লিখেছিলেন- ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত জালিয়াত খেলছো জুয়া’। অথবা ‘হিন্দু না ওরা মুসলমান, ঐ জিজ্ঞাসে কোনজন? কাণ্ডারী বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র’। দেশকে তিনি বারবারই মাতৃরূপেই তুলে ধরেছেন। যে মাতৃমুক্তির কথা বারবার তুলে ধরেছেন- কখনো শ্যামাসঙ্গীতের আড়ালে, কখনো বা দেশাত্মবোধ কবিতায় অথবা প্রতিবাদ মুখোর লেখায়।


তাই একসময় ‘বাঙালির বাংলা’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন- ‘বাংলার সব শিশুকে বালককে এই শিক্ষা দাও- এই মন্ত্র দাও- যে বাংলা হচ্ছে বাঙালির…… বলো জয় বাংলার জয়’। অনেকে বলে থাকেন ‘এই জয় বাংলার জয়’ থেকেই পূর্ববঙ্গের মুক্তি সংগ্রামে শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানে মুখর হয়ে উঠেছিল। এমনকি বর্তমানেও আমাদের রাজ্যে ‘মা-মাটি-মানুষ’ এর সরকারের একটি অন্যতম শ্লোগান ‘জয় বাংলা’। অধ্যাপক শিবনারায়ণ রায় কবির গান ও কবিতা মূল্যায়ন প্রসঙ্গে বলেছিলেন- ‘নজরুলের গান ও কবিতা একেবারে নিচ থেকে ওঠা মানুষের গান। যারা দলিত, যারা অত্যাচারিত, যাদের ভাষা ছিলনা, নজরুলের কলমে তারা ভাষা খুঁজে পেল’।


এবার আসা যাক কাজী নজরুলের ইসলামিক সঙ্গীত বিষয়ে।যদিও মধ্যযুগে সৈয়দ আলাউল ও দৌলত কাজীর হাত ধরে বাংলা সাহিত্যে মুসলমান সাহিত্য ও সাহিত্যিকের আবির্ভাব ঘটে।পরবর্তীকালে আধুনিক যুগে মুসলিম সাহিত্যিকের হাত ধরে বাংলাসাহিত্যে ইসলামিক সাহিত্যের ব্যাপক প্রসার ঘটে। এই পর্যায়ে ইসলামিক সঙ্গীত রচনায় কাজী নজরুল ইসলাম এখনও অপ্রতিদ্বন্ধী। আমরা জানি ইসলামের মূল পাঁচটি স্তম্ভ হল- ঈমান, নামাজ, রোজা, হজ্জ ও জাকাত।আবার ইসলামের চারটি পন্থা হল- শারিয়ত, তারিকত, মারিফত ও হাকিকত। নজরুল ইসলামের সঙ্গীতেও আমরা এই বিষয়গুলি পাই। পবিত্র কোরান শরীফ ও বুখারী শরীফের প্রত্যেকটা আয়াত ও সুরা সম্বন্ধে তাঁর ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য।কেননা তিনি আরবী ফারসী উর্দু ভাষাও জানতেন।


ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাসউদ্দিন বিরচিত ‘আমার শিল্পজীবনের কথা’ থেকে জানা যায় মূলত আব্বাসউদ্দীনের অনুরোধেই কাজী নজরুল প্রথম ইসলামিক সঙ্গীত রচনা করেছিলেন । কারণ সেইসময় বাংলায় উর্দু কাওয়ালি বা গজল এর পাশাপাশি গ্রাম বাংলায় মুখে মুখে রচিত কিছু ইসলামিক লোকসঙ্গীতের চল ছিল। আব্বাসউদ্দীন যেহেতু মাটির গান গাইতেন; তাই তাঁর চিন্তাভাবনার উদয় হয়েছিল পল্লী বাংলার সুরে ইসলামিক সঙ্গীত আয়োজনের। মূলত আব্বাসউদ্দীনের অনুপ্রেরণায় এবং ভগবতী ভট্টাচার্যের সম্মতিতে নজরুল প্রথম রচনা করেন ইসলামিক সঙ্গীত- ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ/তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ’। এবং অপর গানটি হল- ‘ইসলামেরই ঐ সওদা লয়ে এলো নবীন সদাগর’।


আব্বাসউদ্দীনের কণ্ঠে সেই গান আজও সমান জনপ্রিয়। মূলত এই জনপ্রিয়তা থেকেই নজরুল ইসলামিক সঙ্গীত রচনায় হাত দেন বলে করুণাময় গোস্বামী কর্তৃক বাংলা একাদেমি থেকে প্রকাশিত, ‘নজরুল গীতি প্রসঙ্গ’ ও গাজী আবদুল হাই রচিত ‘নজরুলের ইসিলামী গজল’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়।শ্যামা সঙ্গীতে শ্যামাকে যেমন তিনি কন্যারূপে কল্পনা করেছিলেন তেমনি ইসলামিক সঙ্গীতে শ্রেষ্ঠ নবি হজরত মহম্মদ সালাল্লাহুকে তুলে ধরেছেন পবিত্র কোরান অনুসারে- ‘তোরা দেখে যা আমিনা/মায়ের কোলে,/যেন ঊষার কোলে/রাঙা রবি দোলে’। অন্য একটি গানে উল্লেখ করেছেন- ‘বক্ষে আমার কাবার ছবি/চক্ষে মোহম্মদ রসুল’। ভ্রাতৃত্বের জয়গান গাইতে গিয়ে কবি উল্লেখ করেন- ‘ধর্মের পথে শহীদ যারা, আমরা সেই যে জাতি/ সাম্য মৈত্রী এনেছি আমরা, বিশ্ব করেছি জ্ঞাতি’। পবিত্র কোরানের বিধানকেও তিনি গানের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন-‘আল্লাহর নাম লইয়া বান্দা রোজ ফজরে উঠিও’।ভারতীয় ইসলাম চর্চায় প্রায় সবক্ষেত্রে আরবী ফার্সী উর্দুর প্রভাব রয়েছে সরাসরি। কবির গানেও আমরা সেই প্রভাব লক্ষ্য করতে পারি- ‘শোনো শোনো ইয়া ইলাহি আমার মুনাজাত/তোমারই নাম জপে যেন হৃদয় দিবস-রাত’।


স্মৃতিচারণায় কমিউনিস্ট তাত্ত্বিক নেতা মজফফর আহমদ উল্লেখ করেছেন যে- তিনি ‘সত্যি সত্যি নাস্তিক না হলেও ২০এর দশকে নজরুল বারবার নিজেকে নাস্তিক বলতেন।আদতে বাল্যকাল থেকেই তিনি ছিলেন ধার্মিক এবং অলৌকিকতায় বিশ্বাসী’। এমনকি একটা সময় তিনি তিনি বরদাচরণ মজুমদারের কাছে দীক্ষাও নিয়েছিলেন এবং উদাসী বিবাগী হয়ে ইসলাম থেকে অনেকটা দূরেও সরে গিয়েছিলেন বলেও জানা যায়। কিন্তু স্ত্রী প্রমিলাদেবীর অসুস্থতার দিনদিন অবনতি হলে শোকাহত কবি দীক্ষাগুরু বরদাচরণ মজুমদারকে চিঠিতে লিখেছিলেন- ‘আপনি শিব, আপনার ঔষধের উপর আর কিছু করার ছিলনা।……… শিব বরদাচরণ যদি বাঁচাইতে না পারেন তবে কেউ পারিবেনা’। কিন্তু গুরুদেবের চূড়ান্ত পরামর্শ এসেছিল- ‘যোগসাধনার বদলে তাঁর আসলে নামাজ নেওয়া উচিত ছিল’। এখান থেকেই কবির মানসিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে থাকে। তাই অকপটে কবি জসীমউদ্দিনকে বলতে পেরেছেন- ‘আমি আল্লাহকে দেখেছি’ এবং কিছুদিনের মধ্যেই ঢাকা মুসলিম ছাত্র সম্মেলনের প্রতিনিধিদের উদ্দেশ্যে চিঠিতে লিখেছিলনে- ‘আমি ফকির- আল্লাহর দরবারে আজ আমি পরম ভিক্ষুক……’।


১৯৪০ সাল থেকে তাঁর মধ্যে এই পরিবর্তন আসতে থাকে গভীরভাবে। এমনকি রবীন্দ্রনাথকেও লিখিত চিঠিপত্রে এই সময় তিনি ‘নমস্কার’ ‘প্রণাম’ ইত্যাদির পরিবর্তে ‘সালাম অন্তে রবি’ কবিতায় উল্লেখ করেছেন- ‘তুমি আল্লার রহমত। কালাম ঝরেছে তোমার কলমে, সালাম লইয়া যাও’। ইন্তেকালের বিচারে কবি বিশ্বাস করে আল্লার কাছে প্রার্থনা জানিয়েছেন- ‘রোজ হাশরে আল্লাহ আমার করোনা বিচার/বিচার চাহিনা আমি, দয়া চাহে এ গুণহাগার’।আল্লাহর গুণগান করতে গিয়েই তিনি লিখেছেন-‘ ও মন, কারো ভরসা করিস না তুই/এক আল্লাহর ভরসা কর/আল্লাহ যদি সহায় থাকেন/ভাবনা কিসের, কিসের ডর’। প্রিয় নবি হজরজ্জত মহম্মদের প্রতি তাঁর হৃদয়ে কতটা স্থান ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় নিম্নোক্ত ছত্রটিতে- ‘রাসুলের অপমানে যদি না কাঁদে তর মন/মুসলিম নয়, মুনাফিক তুই, রাসুলের দুশমন’। বিষাদগ্রস্থ কবিচিত্ত মদিনা প্রেমে ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল বলেই তিনি বলেছেন- ‘আমি যদি আরব হতাম মদিনার পথ/সেই পথে মোর চলে যেতেন নূর নবি হজরত’। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে ইসলামের বিধানের কথা। সেই বিধানকে সামনে রেখে কবি লিখেছেন-‘নাই হল মা ভূষণ এই ঈদে আমার/আল্লা আমার মাথার মুকুট, রসুল গলার হার/নামাজ রোজার ওড়না শাড়ি/ ওতেই আমায় মানায় ভারী/ কলমা আমার কপালে টিপ, নাই তুলনা তার’।


কিন্তু সচেতন কবির চোখকে সমাজ এড়িয়ে যেতে পারেনি। মুসলিম সমাজের অবমূল্যায়ন অর্থে তাঁর কাছে ইসলামের অবমূল্যায়নই মনে হয়েছে। এই প্রসঙ্গে ক্ষোভ অভিমানে কলম ধরেছেন-‘কে পিয়েছে সে তৌহিদ-সুধা পরমামৃত হায়?/সেই যে নামাজ রোজা আছে আজো আছে সে কলমা/ আছে আজো উথলায় আব-জমজম-কাবা-শরিফের কাছে’। কবি দ্রুততার সাথে ইসলামিক সঙ্গীত রচনা করতে পারতেন সেই বিষয়ে গায়ক আব্বাসউদ্দিন স্মৃতিকথায় লিখে গেছেন।


নজরুলের ঘরের মেঝেতে আব্বাসউদ্দিন নামাজ পড়তে পড়তে কবি লিখেছিলেন- ‘হে নামাজী! আমার ঘরে নামাজ পড়ো আজ/দিলাম তোমার চরণতলে হৃদয় জায়নামাজ’। মহান আল্লার প্রতি কবির বিশ্বাস এতটাই জন্ম নিয়েছিল যে কবি একজন ফকিরের ন্যায় আকুতি জানিয়েছেন- ‘খোদা এই গরীবের শোনো শোনো মোনাজাত/দিও তৃষ্ণা পেলে ঠাণ্ডা পানি ক্ষুধা পেলে লবন ভাত/মাঠে সোনার ফসল দিও/ দিও গৃহভরা বন্ধু প্রিয়, দিও হৃদয় ভরা শান্তি দিও’।


ইসলামে বর্ণভেদের কোন স্থান নেই। নেই জাতপাতের ভেদাভেদ। সেইদিককে পরিস্ফুট করে কবি আল্লাহর লীলাকে তুলে ধরতে গিয়ে বলেছেন- ‘কেবল মুসলমানের লাগিয়া আসেনি’ক ইসলাম/সত্যে যে চায়, আল্লায় মানে, মুসলম তারি নাম/আমিরে ফকিরে ভেদ নাই, সবে ভাই, সবে একসাথী/আমরা সেই জাতি’। তিনি শুধু মহান আল্লাহর প্রধান নবি’র প্রতিই ভালোবাসা আশা ভরসা ব্যক্ত করেননি।খলিফাদেরও তিনি ইসলাম প্রতিষ্ঠা ও প্রসারে সমান মর্যাদা দিয়েছেন । তাই তিনি লিখেছেন- ‘আবু বকর উসমান উমর আলী হায়দার/দাঁড়ী যে এ তরণীর, নাই ওরে নাই ডর’।আজানের সুরে প্রভাবিত হয়ে কবি লিখেছেন- ‘তিমির রাত্রি এশার আজান শুনি দূর মসজিদে/প্রিয়া হারা কান্নার মতো এ বুকে আসিয়া বিঁধে’।


অতিসংক্ষেপে নজরুলের শ্যামা ও ইসলাম সঙ্গীত একসূত্রে আবদ্ধ করার চেষ্টা করতে গিয়ে মাত্র কয়েকটি গানের উল্লেখ করা গেল। বিস্তৃতভাবে আলোচনা করতে গেলে তা প্রবন্ধ না হয়ে বই-এর রূপে গিয়ে দাঁড়াবে। সেই সাথে শাক্ত বৈষ্ণব ও শৈবর পাশাপাশি ইসলামের সমস্ত আয়াত ও পন্থাকে খুব ভালোভাবে জানতে হবে। জানা দরকার আরবি ফার্সি উর্দু ভাষাও। নিজ চেষ্টায় উর্দু পড়তে লিখতে ও বলতে পারলেও আরবি-ফারসি সম্বন্ধে সম্যক ধারণা নেই। যদিও এইভাষার বর্ণমালাগুলিতে অনেক মিল রয়েছে।নজরুলই একমাত্র বাংলা সাহিত্যের কবি যাঁর গানে প্রভাবিত হয়ে এবং শুধুমাত্র গান গাইবার ও তা বাজারে জনপ্রিয় করে তুলবার জন্য হিন্দু পরিবারের গায়ক মুসলিম নাম ধারণ করেছেন আবার মুসলিম পরিবারের গায়ক হিন্দু নাম ধারণ করেছেন।আবার কেউ কেউ স্বনামেই গেয়েছেন। যেমন-ধীরেন দাস হয়েছেন গণি মিয়া, চিত্ত রায় নামধারণ করেছিলেন দেলোয়ার হোসেন, গিরিন চক্রবর্তী পরিবারের অমতেই হয়ে যান সোনা মিয়া, সীতা দেবী নাম ধারণ করেছিলেন দুলি বিবি, ঊষারাণী নাম পরিবর্তন করে রওশন আরা বেগম, কে মল্লিক পুনরায় হয়েছিলেন মনু মিয়া, তালাত মাহামুদ নাম তপন কুমার নামেই গানের রেকর্ডিং করতেন। আবার কিছু গানে ইসলামের বিভিন্ন প্রধান খলিফা, আলী, পীর প্রমুখের সাথে হিন্দু দেবদেবীর তুলনামূলক আলোচনা উঠে এসেছে।


যে আলোচনার ক্ষেত্রে কবি বাটখাড়াকে সমান রেখে উভয় ধর্ম ও মতাদর্শের গুণগান গেয়েছেন।তেমনি গানে ব্যঞ্জনা প্রয়োগ করেও হিন্দু মুসলিমের সম্প্রীতির জয়গান গেয়েছেন- ‘তাওহীদের হায় এ চির সেবক,ভুলিয়া গিয়াছো সে তাকবীর/ দূর্গা নামের কাছাকাছি প্রায়, দরগায় গিয়া লুটাও শির/ওদের যেমন রাম নারায়ণ, মোদের তেমনি মানিক পীর/ ওদের চাউল ও কলার সাথে, মিশিয়া গিয়াছে মোদের ক্ষীর/ওদের শিব ও শিবানির সাথে আলী ফতেমার মিতালী বেশ/হাসানরে করিয়াছি কার্তিক আর, হোসেনরে করিয়াছি গজ গণেশ’। মানবতার জয়গান গাইতে গিয়েই তিনি যৌবনে শুনিয়েছেন- ‘পূজিছে গ্রন্থ ভণ্ডের দল মূর্খরা সব শোন/ মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোন’।১৯৪২ সালে কবি অসুস্থ হন কিন্তু বাকশক্তি ও স্মৃতি শক্তি হারিয়েও জীবিত ছিলেন ১৯৭৬ পর্যন্ত। জীবনের শেষ ৩৪ বছর তিনি নীরবতার সাথেই কাটিয়েছেন। নইলে কবির থেকে আমরা পেতাম আরও নতুন দর্শন, নতুন নতুন গান ও কবিতা।


আসলে মহাজনদের চলার পথ লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাই তাঁরা কেউই অন্য ধর্মকে খাঁটো করে দেখার বা তুলে ধরার চেষ্টা করেননি। জীবনের পরম প্রাপ্তি যে মোক্ষলাভ বা ঈশ্বর দর্শন বা অনুভব সেই কথাই তাঁরা বারবার বিভিন্ন ভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। সেখানে সাম্প্রদায়িক প্রাধান্য পায়নি। প্রাধান্য পেয়েছে মানবিকতা। তাই রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব একনিষ্ঠ শাক্তের আরাধ্য হলেও তিনি ইসলামে প্রভাবিত হয়ে জীবনের একটা দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেছিলেন। শুধু তাই নয়- খ্রিস্টান ধর্ম চর্চার প্রভাবও তাঁর মধ্যে ছিল। লালন শাহ মানব প্রেমের জয়গান গাইতে গিয়েই ফকিরের বেশে বৈষ্ণব আরাধনা যেমন করেছেন তেমনি কৃষ্ণ আরাধনাতেও পিছপা হননি, মহান নবি, রসুল, আলীদের জয়গানের কথা তাঁর গানের ছত্রে ছত্রে রয়েছে। ইসলাম এর ব্যাখ্যার ক্ষেত্রেও লালন সাঁইজি গুরুবাদী তরিকতের বিভিন্ন দিক নিয়ে গান বেঁধেছেন। সেইদিকে লক্ষ্য রেখেই কবি লিখেছেন- ‘মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান/ মুসলিম তার নয়ন মণি হিন্দু তাহার প্রাণ’।যার মূল কথা ধর্মের নামে ভেদাভেদ থাকলেও মানবধর্মের শেকড় বা গোড়া একটাই। শুধুমাত্র মানবতা নামক বৃক্ষের দুটি ডালে দুটি ফুল। যারা কালের নিয়ে ফুটে উঠে এবং কালের নিয়মেই ঝরে যায়।এই তত্ত্ব উপলব্ধি করেই কবি হয়েছেন অসাম্প্রদায়িক।গেয়েছেন মানবতার জয়গান। কখনো বা শাক্ত শৈব’র মাধ্যমে কখনো বা প্রিয় নবি’র শরণাপন্ন হয়ে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ